বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ি (বাবু বাড়ি) ও প্রাণকৃষ্ণ মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউশন
সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সাতক্ষীরার (পূর্বতন খুলনা) কালীগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রাম। এই জেলার বিশিষ্ট গাতীদার ছিলেন প্রাণকৃষ্ণ সরদার (দাশ)। বিষ্ণুপুর গ্রামটি গাতিদার অর্থাৎ ছোট জমিদার প্রাণকৃষ্ণ সরদারের (দাশ) জন্যই পরিচিতি লাভ করেছে। প্রাণকৃষ্ণ দাশের পিতা প্রাণনাথ সরদার জমিদারি পত্তন করেন। তিনি বেশ প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। জমিদার প্রাণনাথ সরদার পুকুর খনন করে তার পাশে নির্মাণ করেন কাছারি ঘর। সমাজের উন্নয়নের জন্য প্রয়াসী হন। তবে প্রাণকৃষ্ণ সরদার জমিদারির প্রভূত উন্নতি সাধন করেন এবং বিভিন্ন জনহিতৈষী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। এর ধারাবাহিকতায় বিষ্ণুপুর বাজার চালু করে। এছাড়া একটি দোলমঞ্চ তৈরি করে তাতে প্রতিষ্ঠা করেন সোনার তৈরি রাধাকৃষ্ণ যুগল মূর্তি। এই জমিদার পরিবার স্বজাতি তথা সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নানা জনহিতকর কাজ করেছেন।
বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে নির্মাণ করেন দোলমঞ্চ, চড়ক স্থান, দুটি মদিনা দরগা, কালী মন্দির, দুর্গা মন্ডপ ও গৌড়ীয় মঠ। স্থাপন করেন বিষ্ণুপুর বাজার। কালের বিবর্তনে এসব ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।
সেকালে নানা পূজার্চনায় মাতোয়ারা হয়ে থাকত বিষ্ণুপুর গ্রামের জমিদার পরিবার। এ গ্রামের বসবাসকারী শতভাগ মানুষই ছিল হিন্দু অর্থাৎ কপালী সমাজের। বর্তমানে কিছু মুসলিম বসতিও হয়েছে। দোলযাত্রা, সরস্বতী পূজা, দুর্গাপূজা, লক্ষী পূজা, বাসন্তী পূজা, মনসা পূজা, বিশ্বকর্মা পূজা, চড়ক পূজা, কালী পূজা সহ ১২ মাসে ১৩ পার্বণ হতো এখানে। এতে অংশ নিতেন বিভিন্ন ধর্ম মতের মানুষজন। বিষ্ণুপুর গ্রাম পরিণত হতো মিলনমেলায়। সময়ের বিবর্তনে জমিদারের জমিদারীত্ব বিলীন হয়ে গেছে। জমিদার বাড়ি, গোবরাখালীর মদিনা দরগা ও দোলমঞ্চটি অস্তিত্ব সংকটে। জমিদারের কিছু বংশধরেরা পাড়ি জমিয়েছেন ভারতবর্ষে। কিছু বংশধরেরা এখনো বসবাস করছেন পূর্বপুরুষের ভিটে মাটিতে। পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির বারান্দায় এখনো শোভা পাচ্ছে পুরোনো পালকি। গোবরাখালীর মদিনা দরগাটি একটি বট গাছের কোলে আশ্রয় নিয়েছে।
এই জমিদার পরিবারের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হলো স্কুল স্থাপনা। জ্ঞানচর্চায় তৈরি করা মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি হল - বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় (প্রাণকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুল)। আবার প্রাণকৃষ্ণ মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউশন নামেও পরিচিত। রামকৃষ্ণ সরদার (দাশ)-র ছয় ছেলে - পান্নালাল, কিশোরীমোহন, বিজয়কৃষ্ণ, বিনয়কৃষ্ণ, মাখনলাল ও ননীকৃষ্ণ সর্দার (দাশ)। পিতার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এলাকার ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য উচ্চ বিদ্যালয়টি স্থাপন করেন। পার্শ্ববর্তী শ্যামনগর ও আশাশুনিতে কোন উচ্চবিদ্যালয় না থাকায় এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত ওইসব এলাকার শিক্ষার্থীরা। দূরবর্তী ছাত্রদের জন্য নির্মিত বোর্ডিং হাউসে অনেক ছাত্র থাকতো। এ বিদ্যালয়ের ফলাফল দেখে ঈর্ষান্বিত হতো অনেকেই। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয়টি স্থাপন করা হয় এবং ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ১৮ই ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অস্থায়ী স্বীকৃতি লাভ করে।
জমিদার বাড়ির গৌড়ীয় মঠ বনদেব গোস্বামী মহারাজ প্রতিষ্ঠা করেন। একটি প্রাচীন আশ্রম, বৈষ্ণব মঠ, নিয়মিত নিত্যসেবা হয়। কার্তিক ব্রত, একাদশী ও জন্মাষ্টমী সহ বার্ষিক সপ্তাহব্যাপী ভাগবত পাঠ অনুষ্ঠান হয়। জমিদার বাড়ির দুর্গা মন্দির এখনো বিদ্যমান, প্রতিবছর মন্দিরে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষীকান্তপুরের কুখ্যাত রাজাকার আবুল কাশেম বিষ্ণুপুরের দোলমঞ্চ থেকে সোনার তৈরি রাধাকৃষ্ণ মূর্তি ও সোনার দোলনা পাঠ লুঠ করে নিয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিঙ্গলগঞ্জে মুক্তিকামী জনতার হাতে নিহত হন। এরপর থেকে দোলযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। এলাকাবাসী বঞ্চিত হয় কলকাতার শিল্পীদের মঞ্চস্থ যাত্রাপালা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সার্কাস প্রদর্শনী থেকে। এখন প্রাণ নেই বিষ্ণুপুর বাজারের। পুজা হলেও জৌলুস ছাড়িয়ে গেছে কালীমন্দিরের। গৌড়ীয় মঠ ও চড়ক পুজার স্থানটি কোন প্রকারে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয় পুরাতন ঐতিহ্য মেনে। প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়টি সংস্কার করা হলেও সেখানে পর্যাপ্ত ঘরের অভাব রয়েছে। সব মিলিয়ে স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে বিষ্ণুপুরের জমিদারদের প্রাচীন ঐতিহ্য।
ঠিক সেই সময় ২৮-২৯ বছর পূর্বে বন্ধুমহল ক্লাব বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ির প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে আড়ম্বর পূর্ণ সরস্বতী পুজা শুরু করে। ক্রমশ এ পূজা রূপ নেয় সর্বজনীন রূপে। গ্রামে অনুষ্ঠিত সকল পারিবারিক পুজার সমন্বয়ে বিসর্জনের দিনে র্যালি হত। আয়োজন করা হয় আলোকসজ্জার। এর এক দশক পরে প্রায় ১৮-১৯ বছর আগে বিষ্ণুপুর ফুটবল মাঠে প্রান্তিক সংঘও শুরু করে সরস্বতী পুজা। ব্যয়বহুল সুসজ্জিত প্যান্ডেল ও আলোকসজ্জায় সজ্জিত সরস্বতী পুজা উপলক্ষে দুই সংস্থার উদ্যোগে সপ্তাহব্যাপী পঞ্চমী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় যাতে কোনরকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতি না ঘটে সেজন্য সর্বক্ষণ কাজ করে যায় স্বেচ্ছাসেবকগণ। দায়িত্ব পালন করে পুলিশও। সব মিলিয়ে বিষ্ণুপুরের হারানো ইতিহাস ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগের কোন ত্রুটি নেই। ক্লাব ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আবারো ফিরে আসতে পারে বিষ্ণুপুরের জমিদারদের হারানো গৌরব। এ সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে সরকারিভাবে জমিদার বাড়ি, দোলমঞ্চ, গৌড়ীয় মঠ ও গোবরা খালির মদিনা দরগা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা খুবই দরকার।
তথঃ
১) মৃন্ময় সরদার, সাক্ষাৎকার - ১৪/১০/২০২২
২) উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ, সম্পাদকঃ প্রবীর শিকদার, ঢাকা। ১৩/০২/২০১৬।