Sunday, February 12, 2023

দিনাজপুর জেলার ইতিহাস অনুসন্ধান দ্বিতীয় খণ্ড

দিনাজপুর জেলার ইতিহাস অনুসন্ধান ( দ্বিতীয় খণ্ড )





দিনাজপুর জেলার ইতিহাস অনুসন্ধান দ্বিতীয় খন্ড

 প্রকাশক : চক্রবর্তী এন্ড সন্স পাবলিকেশন

 সম্পাদনা : শুভঙ্কর রায় প্রবীর চন্দ্র দাস

 মুদ্রিত মূল্য  - ৪৫০ টাকা
 (ছাড় - ২০ % )  

সংগ্রহ করতে যোগাযোগ করুন - 9735069594 / 9831839558 (Call/WhatsApp)

Saturday, January 21, 2023

বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ি

বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ি (বাবু বাড়ি) ও প্রাণকৃষ্ণ মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউশন


সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সাতক্ষীরার (পূর্বতন খুলনা) কালীগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রাম। এই জেলার বিশিষ্ট গাতীদার ছিলেন প্রাণকৃষ্ণ সরদার (দাশ)। বিষ্ণুপুর গ্রামটি গাতিদার অর্থাৎ ছোট জমিদার প্রাণকৃষ্ণ সরদারের (দাশ) জন্যই পরিচিতি লাভ করেছে। প্রাণকৃষ্ণ দাশের পিতা প্রাণনাথ সরদার জমিদারি পত্তন করেন। তিনি বেশ প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। জমিদার প্রাণনাথ সরদার পুকুর খনন করে তার পাশে নির্মাণ করেন কাছারি ঘর। সমাজের উন্নয়নের জন্য প্রয়াসী হন। তবে প্রাণকৃষ্ণ সরদার জমিদারির প্রভূত উন্নতি সাধন করেন এবং বিভিন্ন জনহিতৈষী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। এর ধারাবাহিকতায় বিষ্ণুপুর বাজার চালু করে। এছাড়া একটি দোলমঞ্চ তৈরি করে তাতে প্রতিষ্ঠা করেন সোনার তৈরি রাধাকৃষ্ণ যুগল মূর্তি। এই জমিদার পরিবার স্বজাতি তথা সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নানা জনহিতকর কাজ করেছেন।

বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে নির্মাণ করেন দোলমঞ্চ, চড়ক স্থান, দুটি মদিনা দরগা, কালী মন্দির, দুর্গা মন্ডপ ও গৌড়ীয় মঠ। স্থাপন করেন বিষ্ণুপুর বাজার। কালের বিবর্তনে এসব ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।

সেকালে নানা পূজার্চনায় মাতোয়ারা হয়ে থাকত বিষ্ণুপুর গ্রামের জমিদার পরিবার। এ গ্রামের বসবাসকারী শতভাগ মানুষই ছিল হিন্দু অর্থাৎ কপালী সমাজের। বর্তমানে কিছু মুসলিম বসতিও হয়েছে। দোলযাত্রা, সরস্বতী পূজা, দুর্গাপূজা, লক্ষী পূজা, বাসন্তী পূজা, মনসা পূজা, বিশ্বকর্মা পূজা, চড়ক পূজা, কালী পূজা সহ ১২ মাসে ১৩ পার্বণ হতো এখানে। এতে অংশ নিতেন বিভিন্ন ধর্ম মতের মানুষজন। বিষ্ণুপুর গ্রাম পরিণত হতো মিলনমেলায়। সময়ের বিবর্তনে জমিদারের জমিদারীত্ব বিলীন হয়ে গেছে। জমিদার বাড়ি, গোবরাখালীর মদিনা দরগা ও দোলমঞ্চটি অস্তিত্ব সংকটে। জমিদারের কিছু বংশধরেরা পাড়ি জমিয়েছেন ভারতবর্ষে। কিছু বংশধরেরা এখনো বসবাস করছেন পূর্বপুরুষের ভিটে মাটিতে। পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির বারান্দায় এখনো শোভা পাচ্ছে পুরোনো পালকি। গোবরাখালীর মদিনা দরগাটি একটি বট গাছের কোলে আশ্রয় নিয়েছে।

এই জমিদার পরিবারের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হলো স্কুল স্থাপনা। জ্ঞানচর্চায় তৈরি করা মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি হল - বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় (প্রাণকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুল)। আবার প্রাণকৃষ্ণ মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউশন নামেও পরিচিত। রামকৃষ্ণ সরদার (দাশ)-র ছয় ছেলে - পান্নালাল, কিশোরীমোহন, বিজয়কৃষ্ণ, বিনয়কৃষ্ণ, মাখনলাল ও ননীকৃষ্ণ সর্দার (দাশ)। পিতার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এলাকার ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য উচ্চ বিদ্যালয়টি স্থাপন করেন। পার্শ্ববর্তী শ্যামনগর ও আশাশুনিতে কোন উচ্চবিদ্যালয় না থাকায় এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত ওইসব এলাকার শিক্ষার্থীরা। দূরবর্তী ছাত্রদের জন্য নির্মিত বোর্ডিং হাউসে অনেক ছাত্র থাকতো। এ  বিদ্যালয়ের ফলাফল দেখে ঈর্ষান্বিত হতো অনেকেই। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয়টি স্থাপন করা হয় এবং ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ১৮ই ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অস্থায়ী স্বীকৃতি লাভ করে।

জমিদার বাড়ির গৌড়ীয় মঠ বনদেব গোস্বামী মহারাজ প্রতিষ্ঠা করেন। একটি প্রাচীন আশ্রম, বৈষ্ণব মঠ, নিয়মিত নিত্যসেবা হয়। কার্তিক ব্রত, একাদশী ও জন্মাষ্টমী সহ বার্ষিক সপ্তাহব্যাপী ভাগবত পাঠ অনুষ্ঠান হয়। জমিদার বাড়ির দুর্গা মন্দির এখনো বিদ্যমান, প্রতিবছর মন্দিরে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষীকান্তপুরের কুখ্যাত রাজাকার আবুল কাশেম বিষ্ণুপুরের দোলমঞ্চ থেকে সোনার তৈরি রাধাকৃষ্ণ মূর্তি ও সোনার দোলনা পাঠ লুঠ করে নিয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিঙ্গলগঞ্জে মুক্তিকামী জনতার হাতে নিহত হন। এরপর থেকে দোলযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। এলাকাবাসী বঞ্চিত হয় কলকাতার শিল্পীদের মঞ্চস্থ যাত্রাপালা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সার্কাস প্রদর্শনী থেকে। এখন প্রাণ নেই বিষ্ণুপুর বাজারের। পুজা হলেও জৌলুস ছাড়িয়ে গেছে কালীমন্দিরের। গৌড়ীয় মঠ ও চড়ক পুজার স্থানটি কোন প্রকারে কালের সাক্ষী হয়ে আছে।  দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয় পুরাতন ঐতিহ্য মেনে। প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়টি সংস্কার করা হলেও সেখানে পর্যাপ্ত ঘরের অভাব রয়েছে। সব মিলিয়ে স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে বিষ্ণুপুরের জমিদারদের প্রাচীন ঐতিহ্য।

ঠিক সেই সময় ২৮-২৯ বছর পূর্বে বন্ধুমহল ক্লাব বিষ্ণুপুর জমিদার বাড়ির প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে আড়ম্বর পূর্ণ সরস্বতী পুজা শুরু করে। ক্রমশ এ পূজা রূপ নেয় সর্বজনীন রূপে। গ্রামে অনুষ্ঠিত সকল পারিবারিক পুজার সমন্বয়ে বিসর্জনের দিনে র‍্যালি হত। আয়োজন করা হয় আলোকসজ্জার। এর এক দশক পরে প্রায় ১৮-১৯ বছর আগে বিষ্ণুপুর ফুটবল মাঠে প্রান্তিক সংঘও শুরু করে সরস্বতী পুজা। ব্যয়বহুল সুসজ্জিত প্যান্ডেল ও আলোকসজ্জায় সজ্জিত সরস্বতী পুজা উপলক্ষে দুই সংস্থার উদ্যোগে সপ্তাহব্যাপী পঞ্চমী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় যাতে কোনরকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতি না ঘটে সেজন্য সর্বক্ষণ কাজ করে যায় স্বেচ্ছাসেবকগণ। দায়িত্ব পালন করে পুলিশও। সব মিলিয়ে বিষ্ণুপুরের হারানো ইতিহাস ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগের কোন ত্রুটি নেই। ক্লাব ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আবারো ফিরে আসতে পারে বিষ্ণুপুরের জমিদারদের হারানো গৌরব। এ সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে সরকারিভাবে জমিদার বাড়ি, দোলমঞ্চ, গৌড়ীয় মঠ ও গোবরা খালির মদিনা দরগা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা খুবই দরকার।


তথঃ

১) মৃন্ময় সরদার, সাক্ষাৎকার - ১৪/১০/২০২২
২) উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ, সম্পাদকঃ প্রবীর শিকদার, ঢাকা। ১৩/০২/২০১৬।

Tuesday, October 4, 2022

দেবহাটা জমিদার বাড়ি

দেবহাটা জমিদার বাড়ি

দাতব্য চিকিৎসালয়, রাণী কুঠির, দেবহাটা মডেল স্কুল, ফুটবল মাঠ, রাস্তাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন তৎকালীন জমিদার, আধুনিক দেবহাটার স্থপতি ফনী ভূষণ মণ্ডল। একমাত্র জমিদার হিসেবে নানাবিধ কাজ করেছেন দেবহাটার উন্নয়নে। ফনী ভূষণ মণ্ডলের অবদানের কথা জানতে দূর-দূরান্ত থেকে আসে হাজারও মানুষ। জানতে চায় এসব ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা।

প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর আবাসভূমি সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলা। সমগ্র দেবহাটায় একজন জমিদারের বসবাস ছিল। ১২ জন জমিদার বাস করতেন টাউন শ্রীপুরে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জমিদার ছিলেন ফনী ভূষণ মণ্ডল।

ফনী ভূষণ মণ্ডল ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে দেবহাটার সম্ভ্রান্ত গাতিদার (ছোট জমিদার) পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা বিপেন বিহারী মণ্ডল ছিলেন একজন গাতিদার। মায়ের নাম ভুবন মোহিনী। জনশ্রুতি অনুযায়ী ফনী ভূষণ মণ্ডল অর্থ দিয়ে জমিদারী ক্রয় করেন। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ পর্যন্ত তিনি জমিদার হিসেবে দেবহাটার সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে গেছেন।

দেবহাটায় শিক্ষা বিস্তারে ফনী ভূষণ মণ্ডলের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তিনি এলাকার মানুষের জন্য ১৯১৯ সালে নিজ জমির উপর বিপেন বিহারী মেমোরিয়াল পাবলিক ইনস্টিটিউট ও একটি ফুটবল মাঠ প্রতিষ্ঠিত করেন। স্কুলটি জাতীয়করণের পরে নাম রাখা হয় দেবহাটা বি.বি.এম.পি. ইনস্টিটিউশান (মডেল স্কুল)। কলকাতার বেনারস ইউনিভার্সিটি থেকে ফনী ভূষণ মণ্ডল স্থায়ীভাবে স্বীকৃতি (আজীবন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত) নিয়ে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন।

জমিদার হিসেবে ফনী ভূষণ মণ্ডল দেবহাটার মানুষের চিকিৎসা সেবার জন্য মায়ের নামে ১৯১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালে ভুবন মোহিনী ভিক্টোরিয়া চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি মানুষের একমাত্র চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ভুবন মোহিনী ভিক্টোরিয়া চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি দেবহাটায় প্রথম চিকিৎসা কেন্দ্র। পরবর্তীতে এটি ব্যবহৃত হতো দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে। বর্তমানে দাতব্য প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশের অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ।

এছাড়া জমিদার ফনী ভূষণ মণ্ডল বিনোদনের জন্য তৈরি করেন রাণী কুঠির। পরবর্তীতে ১৯১৯ সালে এটি বাংলাদেশ পুলিশের থানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সাতক্ষীরা জেলার সবচেয়ে প্রাচীন থানার মর্যাদা পায় দেবহাটার রাণী কুঠির। বর্তমানে সেই রাণী কুঠির আর নেই। কিন্তু রয়েছে দেবহাটা থানা। রাণী কুঠির ভেঙ্গে তৈরি করা হয়েছে থানা নতুন ভবন। 

ফনী ভূষণ মন্ডলের অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। দেবহাটা ছিল জঙ্গলে ভরা। ওপারে ভারত, এপারে বাংলাদেশ। মাঝখানে ইছামতি নদী। ব্রিটিশ শাসনামলে খুব বড় মাপের জমিদার ছিলেন তিনি। দেবহাটায় তিনিই প্রথম তার মায়ের নামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন। আরাম-আয়েশের জন্য রাণী কুঠির প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বর্তমানে থানা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।”

দেবহাটা উপজেলার পুরো দেবহাটায় একজন জমিদারের বসবাস ছিল। টাউন শ্রীপুরে ছিল ১২ জন জমিদার। সব থেকে বড় জমিদার ছিলেন ফনী ভূষণ মণ্ডল। দেবহাটায় শিক্ষা বিস্তারে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। নিজ জমির উপর ১৯১৯ সালে দেবহাটায় তার বাবার নামে বিপেন বিহারী মেমোরিয়াল পাবলিক ইনস্টিটিউশান নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলটির জন্য তিনি কলকাতার বেনারস ইউনিভার্সিটি থেকে আজীবন স্বীকৃতি নিয়ে আসেন। এ কারণে স্কুলের নিবন্ধন প্রয়োজন হয়নি কখনো।

তৎকালে দেবহাটায় থানা করার জন্য দুই হাজার টাকার বাজেট দেয় ব্রিটিশ সরকার। পরবর্তীতে ফনী ভূষণ মণ্ডল রাণী কুঠির ও বিভিন্ন আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন দেবহাটা থানা। যা বর্তমানে এখনো পর্যন্ত বহাল আছে।”

সব মিলিয়ে ফনী ভূষণ মণ্ডল ব্রিটিশ শাসনামলে দেবাহাটার সার্বিক উন্নয়নের কারিগর হিসেবে কাজ করে গেছেন। তার এই উল্লেখযোগ্য অবদানের কথা এখনো পর্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে দেবহাটার হাজারও মানুষ। দর্শনার্থীরা স্মৃতিচারণ করেন শ্রদ্ধাভরে।

Tuesday, August 9, 2022

বৈরহাট্টার বুড়িমেলা



বৈরহাট্টার বুড়িমেলা

শুভঙ্কর রায়

বাঙালির লৌকিক ও জনপ্রিয় উৎসব মেলা। মূলত গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে মেলার উৎপত্তি। তবে কবে, কিভাবে মেলার উৎপত্তি তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন। বিশেষ কোন পরব বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই মেলার প্রচলন হয়েছে। মেলার আক্ষরিক অর্থ মিলন।মেলা-ই পারে অজানা - অচেনা মানুষদের একত্রিত করতে, ভাব বিনিময়ের সুযোগ করে দিতে। কবি অতুলপ্রসাদ সেন বলেছেন-

"নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান,
বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান।"

কবি ঠিকই বলেছেন।মানুষের ভাষা, মত , পোশাক-আষাক ভিন্ন হলেও উৎসব ও মেলাই পারে সকলকে এক মঞ্চে হাজির করতে । মেলা মানেই মিলনক্ষেত্র। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম হলো মেলা। মানুষের ব্যস্ত জীবন ও একঘেয়েমি জীবন যাপনে আনন্দ বয়ে আনে মেলা। মেলায় নানা শ্রেণীর মানুষের সমাগম ঘটে, মানুষে - মানুষে এবং শিল্পী ও শিল্পের সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে।

উত্তরবঙ্গে মূলত ধর্মীয় উৎসব, পূজা-পার্বণকে কেন্দ্র করে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলা ও উৎসব একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। পূজা- উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলা বসে আর মেলা-ই পূজা উৎসবের পূর্ণতা আনে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় অনেক প্রাচীন মেলা ও উৎসব। নানা রকম পরিস্থিতির মধ্যে কোনটি বন্ধ হয়ে গেছে , আবার কোনোটি টিকে রয়েছে।তেমনই একটি প্রাচীণ মেলা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার হরিরামপুর ব্লকের বৈরহাট্টার বুড়ি মেলা।

বৈরহাট্টার বুড়িকালী পুজা ও পুজা উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মেলা দুশো বছরের পুরোনো।প্রথমে গড়দিঘীর পাড়ে জঙ্গলঘেরা ফুলতলা নামক স্থানে পুজা শুরু হলেও পরে সরিয়ে আনা হয় বৈরহাট্টা এলাকায়।মন্দিরে কোন মূর্তি নেই।পরিবর্তে রয়েছে কাঠের তৈরী বুড়াবুড়ির মুখোস।বুড়াবুড়ি এখানে চন্ডী বা দূর্গা হিসেবে মান্যতা পান। প্রতি বৎসর কার্তিক মাসে যেকোন বুধবার পুজা আরম্ভ হয় এবং তিনদিন পর্যন্ত এই উৎসব চলে।

দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অন্যতম লৌকিক দেবী বুড়িমা। বট বা অশ্বত্থ গাছের নিচে চালাঘরে বুড়িমার মূর্তি দেখা যায়। গায়ের রঙ ফ্যাকাসে হলুদ, মাথায় সাদা চুল, পরনে সাদা শাড়ি। জেলার বিভিন্ন স্থানে বুড়ি মার পুজো হলেও বৈরহাট্টা গ্রামে বুড়িমার পাকা মন্দির নির্মিত হয়েছে এবং এখানে মন্দিরে কোনও মূর্তি নেই। কাঠের তৈরি মুখা বুড়ি কালী রূপে পূজা হয়। এই বুড়িমা পুজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মুখা নাচ। বুড়াবুড়ি, উড়নকালী, মাসনা, চামুণ্ডা ইত্যাদি মুখা গুলি দেবাংশীর হাতের মন্ত্রপূত জলে যেন প্রাণ পায়। মেলার শেষ দিন অর্থাৎ তৃতীয় দিন ভক্তরা একত্রিত হয়ে মুখা নিয়ে তান্ডব নৃত্য করেন। মুখোশ নিয়ে সিঁদুর মাখানো খড়গ হাতে উৎসব প্রাঙ্গণে ঢাকের তালে উদ্যম নিত্য করে। প্রথমে গোল হয়ে নৃত্য শুরু করলেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে মেলা চত্বরে। নাচের দলের যার হাতে খড়গ থাকে, তার মধ্যে দেবী মাতা ভর করেন। স্থানীয় ভাষায় একে পাতা পড়া বলে। পাতা পড়া ব্যক্তির চেহারা ভয়ঙ্কর হয়ে যায়। নানাভাবে মিনতি স্তুতি করে উদ্যম নৃত্য থামাতে হয়। সে নৃত্য প্রবল ভয়ংকর। ভর পড়া ব্যক্তিটিকে সবাই বুড়িকালী মনে করেন। ভক্তরা কাতর স্বরে নানা সমস্যার কথা জানান এবং বুড়িকালী মা ভর করা ব্যক্তির মুখ দিয়ে সমাধানের পথ বলে দেন। মানুষের যেমন ভয় করেন আবার ভক্তিভরে বিশ্বাসও করেন। এই বিশ্বাসের ফল ভক্তরা পান। তাই বৈরহাট্টার বুড়িকালী খুব জাগ্রত দেবী বলে প্রচলীত। 

পূর্বে চালা যুক্ত ঘরে মায়ের আসন থাকলেও বর্তমানে ইস্টক নির্মিত মন্দির স্থাপন করা হয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণে বহু দূর দূরান্ত থেকে অগণিত ভক্ত সমাগম যেমন ঘটে তেমনি দোকানপাটও আসে ।শুধু মনিহারী বা খাবার-দাবারের দোকান নয় ।কাঠের আসবাবপত্র, খেলনা, জামা কাপড়ের দোকান, জিলিপি পাপড় ভাজা এবং বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী পসরা সাজিয়ে বসে মেলাকে প্রাণবন্ত করে তোলে ।এছাড়া পুতুলনাচ, চিত্রহার, নাগরদোলা, সার্কাস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।


তিনদিন ধরে চলা মেলায় বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সমাগমে ও দোকান পাটের ভিড়ে আনন্দ উদ্দীপনায় ভরে উঠে মেলা প্রাঙ্গণ।

Tuesday, August 2, 2022

নাটাই চন্ডীর ব্রত




নাটাই চন্ডীর ব্রত

শুভঙ্কর রায়



ব্রতের সংজ্ঞায় বলা যায় যে কোন অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য কায় মনোবাক্যে যে কৃত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়, তাই হলো ব্রত। এই বিশাল ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন ধর্মের ও বিভিন্ন ভাষা-ভাষীর মানুষজন বাস করেন। প্রত্যেকেরই নিজস্ব আচার-আচরণ, ব্রত পার্বণ আছে । ' যার মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যাক্তি জীবনে সুখ শান্তির কামনা করেন। সেই রকমই দক্ষিণ দিনাজপুর তথা উত্তরবঙ্গের মানুষের রয়েছে নানা ব্রত - পার্বণ। তারই একটি ব্রতের নাম নাটায় চন্ডী ব্রত। অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার এই ব্রত পালন করা হয়। নাটাই চন্ডী ব্রত পালনের মাধ্যমে সাংসারিক জীবনে নানা বাধা-বিপত্তি থেকে মুক্তি লাভ হয়ে থাকে এই ধারণা চিরকাল মানুষের মনে বিরাজ করছে। তাই গ্রামাঞ্চলে আজও নাটাই চন্ডীর ব্রত-পুজা হয়ে চলেছে সাড়ম্বরে।

অগ্রহায়ণ মাসের প্রত্যেক রবিবার  ব্রত পালন হয়ে থাকে কোন না কোন বাড়িতে । তবে প্রতি বাড়িতে অন্তত দুই রবিবার এই ব্রত পালন করা হয়। এই ব্রত পালনে কোনো পুরোহিত বা অধিকারী প্রয়োজন হয় না। গৃহস্থ বাড়ির গৃহিণী ও ছোট ছেলে-মেয়েরা এই ব্রত পূজা সম্পন্ন করে থাকে। ব্রত পূজার উপকরণের মধ্যে ধান,দূর্বা, তুলসি,সিঁদুর,কচুপাতা বা ভেরেন্ডা পাতা,নাটাই (কচুরী) পানা, ছোট শামুক,সরষে ফুল, চালের গুড়ো, গুড়-সন্দেশ বা বাতাসা , পিঠা। সকাল থেকে এই সমস্ত উপকরণ জোগাড় করে রাখে। বিকেল থেকে পুজোর জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। মূলত সন্ধ্যেবেলা হয় এই ব্রত উৎসব পালন। তুলসী তলায় ছোট পুকুর খনন করে তার মধ্যে জল, কচুরিপানা,শামুক দেওয়া হয়। পুকুরের সামনে সিঁদুর দ্বারা প্রতীকী পুত্তলিকা আঁকতে হয়। এছাড়া একটি ছোট বেদী করা হয় তাতে চালের গুঁড়ো ও সর্ষেফুল দেওয়া হয়। পুজোরপূজোর প্রসাদ পিঠা।কপালী সমাজে একে চাপরি পিঠা বলা হয়। এই পিঠা দুই রকমের তৈরি করা হয়। এক নুন ছাড়া ও স্বাদমতো নুন দিয়ে। দুই রকমের পিঠা কচু পাতা বা ভেরেন্ডা পাতার মধ্যে প্রসাদ করে রাখা হয়। গৃহস্থ বাড়ির গৃহিণী নাটাই চন্ডী ঠাকুরকে পুজা দেন এবং পুজা শেষে নাটাই চন্ডীর ব্রতকথা শোনান ছেলে-মেয়েদের। শুধু বাড়ির ছেলে মেয়েরা নয়, প্রতিবেশি ছেলেমেয়েরা অংশগ্রহণ করে। ব্রতকথা শেষে প্রসাদ বিতরণ হয়।

একধনাঢ্য সওদাগরের মাতৃহারা দুই ছেলে-মেয়ে সৎ মায়ের অত্যাচার ও চক্রান্তের হাত থেকে কিভাবে নাটাই চন্ডীর ব্রত পালন করে তাদের দুঃখ দূর হয়। সেই কথা ব্রত পালনের সময় শোনান।


ব্রত কথা শেষ হলে ভেরেন্ডা পাতা বা কচু পাতায় দেওয়া প্রসাদ ছেলে-মেয়েরা কাড়াকাড়ি করে যে যার মত নেয়। শেষে ব্রত পালনকারী গৃহিণী সবাইকে পিঠা প্রসাদ দেন। নুন ছাড়া বা নুন দেওয়া পিঠা প্রসাদ নিয়ে এক জনশ্রুতি আছে, নুন ছাড়া পিঠা প্রসাদ পেলে তার সময় ভালো নয়, আর নুন দেওয়া প্রাসাদ পেলে তার সময় ভালো চলছে সেই নির্দেশ করে ।


যাইহোক বর্তমানেও গ্রামে গঞ্জে নাটাই চন্ডী ব্রত পালন হলেও ব্রত কথা কাউকে বলতে দেখা যায় না। ছেলে মেয়েদের মধ্যেও কাড়াকাড়ি করে প্রসাদ নেওয়ার প্রবণতাও নেই। আজ থেকে দুই দশক আগেও এই দৃশ্য দেখা যেত। এমনকি পাটকাঠিতে পিঠা গেঁথে বাড়ি বাড়ি পিঠা তোলার জন্য ছেলে মেয়েদের দল বেঁধে যেতে দেখা যেত। এসব এখন অতীত। আবু দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা লোকবিশ্বাস, সুখ শান্তি কামনা বা অভিষ্ঠ সিদ্ধির জন্য ব্রত - পূজা- পার্বণ পালন হয়ে আসছে। ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম হবে তা ভাবনার অতীত।

Saturday, July 25, 2020

আলাপন সাহিত্য পত্রিকা

Saturday, May 23, 2020

আলাপন সাহিত্য পত্রিকাঃ জুন সংখ্যা

                       আলাপন সাহিত্য পত্রিকা




দিনাজপুর জেলার ইতিহাস অনুসন্ধান দ্বিতীয় খণ্ড

দিনাজপুর জেলার ইতিহাস অনুসন্ধান ( দ্বিতীয় খণ্ড ) দিনাজপুর জেলার ইতিহাস অনুসন্ধান দ্বিতীয় খন্ড  প্রকাশক : চক্রবর্তী এন্ড সন্স পাবলিকেশন  সম...