পুরাতত্ত্ব বা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হলো প্রাচীন যুগের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নির্ভর বস্তু।যা ভগ্ন-অভগ্ন অবস্থায় থেকে তদীয় অঞ্চলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নির্দেশ করে।এই পুরাতত্ত্বের অনুধাবনের মাধ্যমে ধ্বংসাবশেষ ও বস্তুর শিল্প চর্চার মাধ্যমে কোন সভ্যতাকে পুনরাবিষ্কার করা যায়। জানা যায় সেই স্থানের অতীতের সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে ফ্রান্সিস বেকন লিখেছেন- "পুরাতত্ত্ব হল ইতিহাসের বিবর্ণরূপ বা ইতিহাসের অবশেষ যা কোনভাবে মহাকালের করাল গ্রাস হতে বেঁচে গেছে।" আবার ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এর আইন অনুযায়ী একশত বছরের বেশি পুরনো মুদ্রা, তাম্রলিপি, প্রস্তরলিপি, মন্দির, স্তুপ বা ঢিবি যেগুলির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। সেগুলিকেই পুরাকীর্তি বলে নির্ধারণ করা হয়।
এই তথ্যানুসারে বলা যেতে পারে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় প্রচুর পুরাকীর্তির নিদর্শন রয়েছে। যেগুলির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম । কারণ এই মাটি সুঙ্গ, মৌর্য, গুপ্ত , পাল , সেন, সুলতানি যুগ শাসনের সাক্ষী রয়েছে। সাক্ষী রয়েছে ইংরেজদের শাসন ব্যবস্থার, জমিদারি ব্যবস্থার ঔদ্ধত্যের। সে সমস্ত যুগের প্রচুর নিদর্শন যার কিছু ধ্বংসাবশেষ, কিছু ধ্বংসের মুখে পতিত আবার সংস্কারের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন স্থাপত্য ও ইতিহাস নিয়ে পরিচয় করব।
বিদ্যেশ্বরী মন্দিরঃ- বালুরঘাট থানার পতিরামের বহুকাল প্রাচীন কালী মন্দির আছে। মন্দিরটি বিদ্যেশ্বরী কালীমন্দির নামে পরিচিত। এখানে কোন মূর্তি নেই। একটি বেদীতে লাল কাপড় দিয়ে ঢাকা দেওয়া আছে। লোকবিশ্বাস দেবী ভূগর্ভে অন্তর্নিহত আছে। জনশ্রুতি আছে ভবানী পাঠক (বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপধ্যায় এর 'দেবী চৌধুরাণী' উপন্যাস) এই মন্দিরে নিত্য পুজা দিতে আসতেন।এই স্থান দেবীর একান্নতম শক্তিপীঠ হিসেবে পূজিতা হয়ে আসছে।
বোল্লা মা রক্ষা কালীঃ- উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী পুজা মা রক্ষা কালীর। কোচবিহারের রাস উৎসব এর পরেই বোল্লা মায়ের পুজা ও মেলা। শতাব্দী প্রাচীন এই পুজাকে কেন্দ্র করে চারদিনের মেলায় রোজ লক্ষাধিক ভক্তের সমাগম ঘটে। প্রতি শুক্রবার মায়ের মন্দিরে পুজা হলেও মূর্তি পুজা রাস পূর্ণিমার পরের শুক্রবার হয়। ছয় - সাত হাজার মানতের পাঠা বলি হয়। এছাড়াও শতাধিক মানত কালীর পুজা হয়। বর্তমানে মন্দিরটি সংস্কার হয়ে নতুন রূপ নিয়েছে।
খাঁপুর সিংহবাহিনী মন্দিরঃ- জেলার উল্লেখযোগ্য প্রাচীন স্থাপত্য খাঁপুরের টেরাকোটা সিংহবাহিনী মন্দির।শোনা যায় দিনাজপুর রাজারা মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। কালের নিয়মে মন্দিরটি ধ্বংসের মুখে। রয়েছে এখানে রায়চৌধুরী জমিদারের কাছারি বাড়ি মন্দিরের পাশে জমিদারের বর্তমান প্রন্মরা একটি নতুন কংক্রিট মন্দির স্থাপন করেছেন।এই মন্দিরে পাশে শিবলিঙ্গ ও পাথরের অন্যান্য মূর্তি রয়েছে। সিংহবাহিনী মন্দিরটি রাজ্য হেরিটেজ কমিশন ডকুমেন্টেশন করেছে। জেলাবাসী হেরিটেজ ঘোষণার প্রহর গুনছেন।
হিলি চামুণ্ডা মন্দিরঃ- ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্তে যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীন শহর হিলি। এখানে জমিদার প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাচীন মন্দির আছে। মা চামুণ্ডা এখানে পূজিতা । প্রায় ২০০ বছর পূর্বে হিলির আদি জমিদার রমণ ধর এই মন্দির স্থাপন করেন। চামুন্ডা দেবী প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে একটি কিংবদন্তী আছে। জমিদারের একটি হাতি একদিন স্থানীয় নদীর ঘাটে স্নান করতে গিয়ে শত চেষ্টার পরও আর উঠতে পারে না। সেই রাত্রে জমিদারের স্বপ্নাদেশ হয় যে,দেবী চামুণ্ডা দুটি শিলাখণ্ডের উপর ওই স্নানের ঘাটে আবির্ভূতা হয়েছেন।পরদিন সকালে ঘাটে গিয়ে দুটি শিলাখণ্ডের উপর একটি নিম কাঠের খন্ড দেখতে পান ।জমিদার কাঠ খণ্ডটি দিয়ে চামুন্ডার মুখা তৈরি করিয়ে কাছারিবাড়ির অনতিদূরে ফুল বাগানে মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন।পরবর্তীতে ওই স্থানে আরও কয়েকটি দেব-দেবী স্থাপন করে তিনি একটি মন্দির তৈরি করেন । এই স্থানে এখন ফুলবাগান নেই, কিন্তু মন্দিরটি "ফুলতলার মন্ডপ" নামে পরিচিত। প্রতি বৎসর জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শনিবার মহা আড়ম্বরে মা চামুণ্ডা দেবীর পুজা হয়। মন্দিরটি পরবর্তীতে সংস্কার করা হয়েছে ।
তপনের পোড়াগাছির যন্দিরঃ- পোড়াগাছি গ্রামের তিনটি টেরাকোটা মন্দির আছে। দুর্গা, কালী ও শিব মন্দিরগুলির গায়ে টেরাকোটার নকশা রয়েছে।মন্দিরগুলির সঠিক নির্মাণ বা প্রতিষ্ঠাতা কে তা জানা যায় না। মন্দির ভগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে ।
করদহের শিব মন্দিরঃ- তপনের একটি প্রাচীন গ্রাম করদহ। এখানে প্রাচীন পুরাকীর্তির অনেক নিদর্শন রয়েছে । তারমধ্যে শিব মন্দির উল্লেখ্য। করদহ এর কিংবদন্তি হলো,বান শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধে বাণ রাজার ১০০০ হাতের মধ্যে ৯৯৮ টি হাত কাটা যায় এবং এই স্থানে দাহ করা হয় বলেই এই স্থানের নাম হয় করদাহ বা করদহ।এখানে দিনাজপুর রাজ প্রাণনাথ প্রতিষ্ঠিত "গোপাল জিউ মন্দির" ছিল তা এখন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে । অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে প্রাণনাথ রায় প্রতিষ্ঠিত টেরাকোটার কারুকার্য বিশিষ্ট একটি শিব মন্দির আছে । এই মন্দিরটি করদহের শিব মন্দির নামে পরিচিত । অর্ধভগ্ন মন্দিরের গায়ে সুন্দর নকশা করা এবং রাম - লক্ষণ - সীতা ও হনুমানের মূর্তি খোদাই করা আছে। এখানেই প্রাচীন কষ্টি পাথরের বৌদ্ধ মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল এক শতাব্দী পূর্বে । এছাড়াও অনেক প্রস্তরখণ্ড ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কেউ মালকালী, কেউ সুর কালী রূপে পূজিতা হন।
ভিকাহারের মন্দির বাসিনি মন্দিরঃ- ভিকাহারে জেলার সবচেয়ে উঁচু টেরাকোটার মন্দির রয়েছে। কথিত আছে,স্থাপত্য বিলাসী পুরাকীর্তি প্রিয় দিনাজপুর রাজা প্রাণনাথ রায় মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে। কালের গ্রাসে মন্দিরটির জীর্ণদশা দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের গায়ে অপূর্ব টেরাকোটার কারুকার্য লক্ষ্য করা যায়। মন্দিরের ভেতরে পূজিতা হন একটি প্রস্তরখণ্ড মন্দিরবাসিনী রূপে। কেউ বলেন ভৈরবী, কেউ বলেন মহাকালীর মন্দির। স্থানীয়রা মন্দিরবাসিনী দেবী রূপে পুজা করেন। এখান থেকে গভীর রাত্রে ধূপ ও ফুলের গন্ধ ভেসে আসে। জনশ্রুতি আছে,এক সময় এক তান্ত্রিক এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং সিদ্ধি লাভের জন্য একটি কুমারী মেয়েকে মন্দিরের বেদী স্থানে গর্ত করে সমাহিত করেন। পরবর্তী সময়ে সেই কুমারী মেয়েটিই দেবী রূপে পুজা পেয়ে আসছে।
ভাইওর মায়ের থানঃ- ভাইওর ঘাটুল এ খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে প্রতিষ্ঠিত ১৬ হাত বিশিষ্ট ভৈরবী মূর্তি আছে। স্থানীয় অঞ্চলে মায়ের থান নামেই পরিচিত। এছাড়াও বসন্তী মাতা বা ঘন্টেশ্বরী মাতা নামেও পরিচিত। মূর্তিটি কালী নাকি দুর্গার প্রতিমূর্তি তা নিয়ে সংশয় আছে। অনেকে মনে করেন ১৬ হাত দৃশ্যমান তাই দেবীদুর্গা হতে পারে । দেবী মূর্তিটি তিনটি খণ্ডে খণ্ডিত। দেবীর পদতলে শোয়ানো মূর্তিটি শিব নাকি অসুর তা নির্ণয় করা দুষ্কর হলেও দেবী দুর্গারই পুজা হয়। বৈশাখ মাস থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত প্রতি শনি ও মঙ্গলবার পুজা হয়।
জ্যৈষ্ঠ মাসের কুড়ি তারিখের পর প্রথম মঙ্গলবার বাৎসরিক বড় পুজা ও মেলা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে ৭০-৮০ হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে। বড় পূজার দিন ৬০০র অধিক মানত করা পাঠাবলি হয় । পূর্বে মহিষ বলি প্রথা প্রচলন ছিল শোনা যায়। মায়ের কোন মন্দির ছিল না, উঁচু ঢিবির মধ্যে টিনের ছাউনির তলে মায়ের অবস্থান । বর্তমানে মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে ।তবে মন্দির এর আশেপাশে পাথর ও ইটের ধ্বংসাবশেষ দেখে অনুমান করা যায় বহুকাল পূর্বে মন্দির ছিল। কথিত আছে, মুসলিম যুগে অর্থাৎ পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধে ধর্মান্তরিত কালাপাহাড় দ্বারা মন্দির ও মূর্তি ভেঙেছে।আবার ত্রয়োদশ শতকের প্রথমে তুর্কি বীর বক্তিয়ার খলজি ধ্বংস করেছে এমনটাও শোনা যায়।
জ্যৈষ্ঠ মাসের কুড়ি তারিখের পর প্রথম মঙ্গলবার বাৎসরিক বড় পুজা ও মেলা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে ৭০-৮০ হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে। বড় পূজার দিন ৬০০র অধিক মানত করা পাঠাবলি হয় । পূর্বে মহিষ বলি প্রথা প্রচলন ছিল শোনা যায়। মায়ের কোন মন্দির ছিল না, উঁচু ঢিবির মধ্যে টিনের ছাউনির তলে মায়ের অবস্থান । বর্তমানে মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে ।তবে মন্দির এর আশেপাশে পাথর ও ইটের ধ্বংসাবশেষ দেখে অনুমান করা যায় বহুকাল পূর্বে মন্দির ছিল। কথিত আছে, মুসলিম যুগে অর্থাৎ পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধে ধর্মান্তরিত কালাপাহাড় দ্বারা মন্দির ও মূর্তি ভেঙেছে।আবার ত্রয়োদশ শতকের প্রথমে তুর্কি বীর বক্তিয়ার খলজি ধ্বংস করেছে এমনটাও শোনা যায়।
মনোহলি জমিদার বাড়ির দুর্গা মন্দিরঃ- দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি মনোহলি জমিদার বাড়ি।কাটোয়ার সিন্নি গ্রাম থেকে এসে তারাচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায় মনোহলি জমিদারবাড়ি পত্তন করেন। তিনি শুধু জমিদারি পত্তন করেন নি। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জমিদারবাড়িতে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। যা অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বনেদি বাড়ির পূজো গুলোর মধ্যে অন্যতম । পুজোর জন্য দালান মন্দির নির্মাণ করেছেন । লোকমুখে শোনা যায়, রাজমহলের পাথর চুন-সুরকি দিয়ে মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল ।বিল্ডিং এর ছাদ লোহার পাটাতনের উপর ঢালাই দেওয়া । জমিদারি নেই, কিন্তু পুজা এখনো হয়ে চলেছে । তবে ২০১২ সাল থেকে জমিদার বাড়ির পুজা এখন বারোয়ারি পুজায় পরিণত হয়েছে।জমিদারবাড়ির অনতিদূরে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন মন্দির। সেখানেই পুজা হলেও , মূর্তি গড়ার কাজ হয় জমিদার বাড়ির পূজো মণ্ডপে ।
শকুনি কালী মন্দিরঃ- তপন ব্লকের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত অর্জুন পুর গ্রামে প্রাচীন একটি টেরাকোটার মন্দির আছে । এটি শকুনি কালীমন্দির নামে পরিচিত।মন্দিরের গায়ের টেরাকোটা গুলো অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেলেও যেকোন পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে একথা জোর করে বলা যায়।
বৈদ্যনাথ ধামঃ- কুমারগঞ্জ ব্লকের আত্রেয়ী নদীর ধারে একটি মন্দিরে বৃহৎ শিবলিঙ্গ আছে । এটি বৈদ্যনাথ ধাম নামে পরিচিত। মন্দির স্থাপন এর একটি জনশ্রুতি আছে, স্থানীয় জমিদার দয়াময়ী চৌধুরীর পূর্বপুরুষগণ প্রায় ৩০০-৪০০ বছর পূর্বে বৈদ্যনাথ ধাম স্থাপন করেন। স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস যে এখানে পুজা দিলে আদি বৈদ্যনাথ ধাম যাওয়ার পুণ্য অর্জন করা যায় । এছাড়াও এখানে বারুণী স্নান উপলক্ষে মেলা বসে। বৈদ্যনাথ ধাম এসে বারুণী তিথি ও শিবরাত্রিতে আত্রেয়ী নদীতে স্নান করে মন্দিরে পুজো দিয়ে অগণিত ভক্ত পুণ্য অর্জন করেন ।
মাহুর কিসমত পঞ্চরত্ন মন্দিরঃ- গঙ্গারামপুর ব্লকের মাহুর কিসমত গ্রামে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাচীন টেরাকোটার মন্দির । যা পঞ্চরত্ন মন্দির নামে পরিচিত । মন্দিরটি নির্মাণ কাল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে কেউ বলেন অষ্টম শতকের আবার কেউ সপ্তদশ বা অষ্টাদশ শতকের কোন একসময়ের অনুমান করেন। মন্দিরের পাঁচটি চূড়ার মধ্যে দুটি ইতিমধ্যে ভেঙে পড়েছে। প্রাচীন এই পঞ্চরত্ন মন্দিরের সারা গায়ে বিশেষত প্রবেশদ্বার সংলগ্ন দেওয়ালে বিষ্ণুর দশটি অবতারের ছবি ও অন্যান্য দেব-দেবীর ছবির সাথে সাহেব মেম এর ছবি ও স্থান পেয়েছে। অতীতে প্রাচীন এই মন্দিরে শিবের পুজা হলেও বর্তমানে বিষ্ণুর পুজা হয়। মন্দিরের ভেতরে কোন মূর্তি নেই । টেরাকোটার এই প্রাচীন মন্দিরটি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মাঝে ক্রমশ ধ্বংসের মুখে এগিয়ে চলেছে।
বলরাম মন্দিরঃ- গঙ্গারামপুর ব্লকের সর্বমঙ্গলা গ্রামের পূর্ব দিকে ভাদরা গ্রামের মাঝে রয়েছে অত্যন্ত সুন্দর কারুকার্য বিশিষ্ট টেরাকোটা মন্দির। মন্দিরটি "বলরামের মন্দির" নামে পরিচিত। এটিই জেলার একমাত্র বলরামের মন্দির।
বিরুপাক্ষ বানেশ্বর ধামঃ- প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্র বাণগড়ের একটু উত্তরে শিববাড়ির পূর্বনাম শিববাটি গ্রামে একটি মন্দিরে বিরুপাক্ষ নামের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত আছে। কিংবদন্তী আছে, দ্বাপর যুগে শিবলিঙ্গটি বাণ রাজা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। এই গ্রামে শিব মন্দির প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় গ্রামের নাম হয় শিববাটি, পরবর্তীতে নাম হয়েছে শিববাড়ি । শৈব উপাসক বাণ রাজা এখানে নিত্যপূজা দিতেন।
পঞ্চমুন্ডি বাণলিঙ্গঃ- কুশমন্ডি ব্লকের আমিনপুর গ্রামে ৩০০ বছরেরও পুরনো মায়ের থান মাটিয়া কালীর। দিনাজপুর রাজা প্রাণনাথ এর সমকালীন জমিদার ছিলেন রাজা রাঘবেন্দ্র রায় । হরিপুর এষ্টেটের বড় তরফ জমিদার রাঘবেন্দ্র রায় সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে স্বপ্নাদেশে পুজা শুরু করেন। আমিনপুর ছিল জমিদার বাড়ির কাছারি বাড়ি। কোন মন্দির নেই । খোলা আকাশের নিচে মায়ের বেদী। রাঘবেন্দ্র রায়ের পরবর্তী প্রজন্ম রবীন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী মন্দির করার আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু তার স্বপ্নাদেশ হয় ওই স্থানে মন্দির নির্মাণ করলে তিনি সবংশে ধ্বংস হবেন । তাই আর পাকা মন্দির নির্মাণ হয়নি ।পঞ্চ বৃক্ষ তলে কার্তিকী অমাবস্যা তথা দীপাবলির রাতে মায়ের পুজো হয়।
মন্দির নির্মাণ বন্ধ হলে ১২১১ বঙ্গাব্দে ৭ই জ্যৈষ্ঠ ভূপশ্রী গৌরী প্রসাদ অনতিদূরে শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের ভেতরে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গটি ভারতবর্ষের মধ্যে বিরল প্রকৃতির। শিবলিঙ্গের উপরিভাগে শিবের পাঁচটি মুখমণ্ডল । এটি পঞ্চমুখ বা পঞ্চমুন্ডি বাণলিঙ্গ নামে পরিচিত । এই কষ্টিপাথরের বানলিঙ্গের দুই পাশে দুটি শ্বেত পাথরের শিবলিঙ্গ স্থাপন করা আছে । কাল অতিক্রমে মন্দির ভগ্ন হলে জমিদারের পরবর্তী প্রজন্ম বিপ্লবেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী মন্দিরের পুনঃসংস্কার করেন ১৪০৯ বঙ্গাব্দে।
অষ্টনাগ মূর্তিঃ- কুশমন্ডি ব্লকের একটি প্রাচীন গ্রাম আমলাহার। গ্রামের মধ্যে বড় বড় অনেকগুলি পুকুর আছে । পুকুর খনন বা সংস্কার কালে প্রায়ই উঠে আসে প্রাচীন মূর্তি। সম্প্রতি একটি বিষ্ণুমূর্তি পাওয়া গেছে। এখানেই প্রাচীনকালে প্রাপ্ত অষ্টনাগ মূর্তি, বিষ্ণু মূর্তি ও শিবলিঙ্গ পাওয়া গেছে। মূর্তিগুলি একটি ভিটে মধ্যে স্থাপন করা আছে। মূর্তিগুলো পুরোপুরি ভগ্ন। শিবলিঙ্গটির শুধু গৌরীপট্ট রয়েছে। অষ্টনাগ মূর্তিটি বেশ কয়েকটি খন্ডে বিভক্ত। গ্রামের পুকুর নিয়ে শোনা যায় বহুকাল পূর্বে গ্রামে কোন ভোজের আয়োজন হলে এদের মধ্যে একটি পুকুরে আবেদন জানালে পুকুর থেকে খাওয়া দাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বাসন-কোসন ডাঙায় উঠে আসতো। অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন উপলক্ষে মনসা পুজা হয়। মনসা এখানে "মনসা বুড়ি" নামে অভিহিত।
ছাটিকা দেবী মন্দির ও ভীম দেউলঃ- কুশমণ্ডির করঞ্জি গ্রামে ছাঁটিকা দেবীর মন্দির ও ভীম দেউল আছে। ছাঁটিকা দেবীর পুজা উপলক্ষে কংস ব্রত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয়রা কাস -ব বলে অভিহিত করেন। কিংবদন্তী আছে, পুরাকালে কংস রাজা শক্তিরূপিণী ছাঁটিকা দেবীর পুজা করে দেশের মঙ্গল করতেন। ছাঁটিকা দেবীর মূর্তি ছাড়াও বিষ্ণুমূর্তি, লক্ষ্মী ও গৌরীপট্টহীন শিবলিঙ্গ আছে। মূর্তিগুলি প্রস্তর নির্মিত। মন্দিরের অনতিদূরে পুরাতন স্তুপ বা দেউল চোখে পড়ে। এটি ভীম দেউল নামে পরিচিত। ইতিহাসবিদরা মনে করেন বরেন্দ্রী বিজয়ী কৈবর্ত্য রাজা ভীমের রাজধানী ছিল এখানে। তিনি দিনাজপুর জেলায় দেবতারূপে পুজা পান।পুজাটি মাঘী শুক্লা ত্রয়োদশীতে শুরু হয়ে কৃষ্ণ প্রতিপদে পূর্ণাহুতি দিয়ে পুজা শেষ হয়।
নড়বড়িয়া শিব মন্দিরঃ- কুশমন্ডি ব্লকের বেতাহাড়ের নড়বড়িয়া শিব ব্যতিক্রম। গৌরীপট্টের মধ্যে ঘোরানো যায়। ব্রতীরা দুধ- জল ঢেলে একটু ঘুরিয়ে দিতে পারলেই ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়। শিবলিঙ্গটি ঘোরানো বা নড়ানো যায় বলে এর নাম হয়েছে নড়বড়িয়া শিব।
টাঙ্গন নদীর পশ্চিম পাড়ে নড়বড়িয়া ধাম।যা দিনাজপুর জেলার অন্যতম প্রাচীন শিব মন্দির এবং পূর্ব পাড়ে চৌষা মৌজায় প্রাচীন মশনা কালী মন্দির। লোকশ্রুতি আছে, দুই পাড়ের দুই ঠাকুরের সম্বন্ধ গভীর। কেউ যদি নড়বড়িয়া শিবের পুজা দেয় তাহলে মশনাকেউ পুজা দিতে হয়।নড়বড়িয়ার মাথা উত্তর-পূর্ব দিকে অর্থাৎ মশনার দিকে ঝুঁকে আছে অনেকে মনে করেন ।আবার অনেকের ধারণা যেহেতু মা কামাখ্যা মায়ের মন্দির শিব নড়বড়িয়া মন্দির থেকে উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থান করছে। তার জন্য সেইদিকে শিবলিঙ্গ ঝুঁকে আছে।
অনেক দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন পুত্র সন্তান কামনা করে বা অসুখ বিসুখ থেকে ভালো হতে। শিবরাত্রির দিন থেকে নদীর দুই পাড়ে বিরাট মেলা বসে । ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে অনুমান করা যায় এটি গৌড়বঙ্গের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম শিবরাত্রি মেলা।
বুড়িকালি মন্দিরঃ- হরিরামপুর ব্লক এর বৈরহাট্টা গ্রামে দুশো বছরের পুরনো বুড়ি কালীপূজা । প্রথমে গড়দিঘির পাড়ের জঙ্গল ঘেরা ফুলতলা নামকস্থানে পূজা শুরু করেছিলেন। পরে সরিয়ে আনা হয় বৈরহাট্টা এলাকায়। মন্দিরে কোন মূর্তি নেই। পরিবর্তে রয়েছে কাঠের তৈরি বুড়াবুড়ির মুখোশ। বুড়াবুড়ি এখানে চন্ডী বা দুর্গা হিসেবে মনে করেন ।
এছাড়াও এখানে প্রাচীন অনেক মূর্তি পাওয়া গেছে।উত্তরবঙ্গে প্রথম যে দুটি সূর্য মূর্তি পাওয়া গেছে তার মধ্যে একটি এই বৈরহাট্টা গ্রামেই পাওয়া গেছে। তপনের হলিদানা অঞ্চলে একটি মন্দিরে গণেশ মূর্তি ও ভিকাহার মকদমপুর এলাকায় ভগ্ন লক্ষ্মী মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। সম্প্রতি ভাইওর এর হাটদিঘিতে একটি পুকুরে প্রাচীন কালো কষ্টিপাথরের সূর্য মূর্তি পাওয়া গেছে। মূর্তিটি একটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাড়িতে স্থাপন করে পুজা দেওয়া হয়।
বৈরহাট্টা-একডালা দুর্গঃ-
গৌড়-বরেন্দ্রী ইতিহাসে বৈরহাট্টার গুরুত্ব অপরিসীম ।কৈবর্ত্যদের হাত থেকে বরেন্দ্রভূমি উদ্ধার করে পাল রাজা রামপাল বৈরহাট্টা অঞ্চলে রাজধানী স্থানান্তর করেন।নতুন রাজধানীর নাম দেন রামাবতী । পাল যুগ শেষ হলে বিজয় সেন কর্তৃক ক্ষমতা হস্তান্তর হলে রামাবতী র নতুন নাম হয় বিজয়পুর। সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেন রাজধানীর নতুন নাম দেন লক্ষণাবতী। যা তুর্কিদের কাছের লক্ষ্ণৌতি নামে পরিচিত ছিল। তুর্কিরা বরেন্দ্র আক্রমণ করে রাজপ্রাসাদ কে একটি দুর্গে পরিণত করে নাম দিয়েছিল একডালা দুর্গ। এর ধ্বংসস্তূপ এখনো বিদ্যমান। জনশ্রুতি আছে,মহাভারতের যুগের বিরাট রাজার রাজধানী ছিল এই বৈরাট্টায় বা বৈরহাট্টায়। আর এই বিরাট রাজার নাম অনুসারেই হয়তো এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল বৈরহাট্টা।
গৌড়-বরেন্দ্রী ইতিহাসে বৈরহাট্টার গুরুত্ব অপরিসীম ।কৈবর্ত্যদের হাত থেকে বরেন্দ্রভূমি উদ্ধার করে পাল রাজা রামপাল বৈরহাট্টা অঞ্চলে রাজধানী স্থানান্তর করেন।নতুন রাজধানীর নাম দেন রামাবতী । পাল যুগ শেষ হলে বিজয় সেন কর্তৃক ক্ষমতা হস্তান্তর হলে রামাবতী র নতুন নাম হয় বিজয়পুর। সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেন রাজধানীর নতুন নাম দেন লক্ষণাবতী। যা তুর্কিদের কাছের লক্ষ্ণৌতি নামে পরিচিত ছিল। তুর্কিরা বরেন্দ্র আক্রমণ করে রাজপ্রাসাদ কে একটি দুর্গে পরিণত করে নাম দিয়েছিল একডালা দুর্গ। এর ধ্বংসস্তূপ এখনো বিদ্যমান। জনশ্রুতি আছে,মহাভারতের যুগের বিরাট রাজার রাজধানী ছিল এই বৈরাট্টায় বা বৈরহাট্টায়। আর এই বিরাট রাজার নাম অনুসারেই হয়তো এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল বৈরহাট্টা।
আবার ইতিহাসে এই নামকরণের অন্য যুক্তি রয়েছে ভুবনখ্যাত রামপালের রামাবতী নগরী এর পরে পূর্ব হট্ট, উত্তর হট্ট এবং মদৈহট্ট নামে তিনটি হাট বা হট্ট ছিল । এই তিনটি হট্ট বা হাট লক্ষণ সেন মখদুম শাহ কে দেওয়া বাইশহাজারী স্টেট এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। উল্লিখিত তথ্যে প্রতীয়মান হয় যে রামাবতী নগরীকে বাইরে রেখে বা বাদ দিয়ে তিনি ঐ সকল ভূমি দান করেছিলেন ।সম্ভবত এই জন্যই একডালার পরবর্তী নাম বাহির হট্ট বা বৈরহাট্টা বা বৈরাট্টা হয়েছিল। এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে কৃষিকাজের উন্নতি ও নিত্য ব্যবহারের জন্য রামপাল বেশ কয়েকটি দীঘি খনন করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গড়দিঘী কাকাদিঘী, মালিয়ানদিঘী ও হাতিডুবা দিঘী। আবার আলতাদিঘীর সাথে পৌরাণিক সম্পর্ক জনশ্রুতি আছে। এই অঞ্চলের প্রাচীন অনেক ধ্বংসাবশেষ ও মূর্তি পাওয়া গেছে।উত্তরবঙ্গে সর্বপ্রথম যে দুটি সূর্য মূর্তি পাওয়া গেছে তার একটি এই বৈরহাট্টা গ্রামে । এছাড়াও মহাভারত খ্যাত শমী বৃক্ষ রয়েছে এই গ্রামে।
শমী বৃক্ষঃ- বৈরহাট্টা -কসবার অনতিদূরে পশ্চিম প্রান্তে অতিযত্নে রশমীৈরহাট্টা-য়েছে মহাভারত খ্যাত এই শমীবৃক্ষ । বৃক্ষ টি খুব উঁচু নয়, তবে শাখা প্রশাখা যুক্ত। ডালপালা ও পাতার ভরে নুইয়ে পড়ার উপক্রম।গাছটি দেখেও অনুমিত হয় এটি সেই প্রাচীন বৃক্ষ নয়। মূল গাছের গোড়া থেকে নতুন বৃক্ষের উৎপত্তি হলে যেমনটা হয় , ঠিক তেমন।জনশ্রুতি আছে, মহাভারতের পঞ্চ পান্ডবদের অজ্ঞাতবাস এর সময় এই বৃক্ষের শাখায় অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন এবং বিরাট রাজার রাজধানীতে ছদ্মবেশে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই দুষ্প্রাপ্য বৃক্ষটি পৃথিবীতে নাকি মাত্র তিনটি, তার মধ্যে ভারতবর্ষের মাটিতে দুটি আছে। তার একটি এই বৈরহাট্টা গ্রামে।
আলতাদিঘীঃ- আলতাদিঘী নিয়ে জনশ্রুতি জনৈক রাজার মহারানী একটি দীঘি খননের কথা বলেন। তিনি যতদূর পায়ে হেটে যাবেন বিনা বিশ্রামে। ততো বড় দিঘি খনন করতে হবে । একদিন সকালে রানী হাঁটতে শুরু করলেন সৈন্য-সামন্ত পেছনে পেছনে অনেকটা পথ যাওয়ার পরও হেঁটে যাচ্ছেন ।এভাবে হেঁটে মাত্রাতিরিক্ত হলে দীঘি খননের রাজকোষ শূন্য হয়ে যাবে । তাই সৈন্যগণ মহারানীর অগোচরে পায়ে আলতা ছিটিয়ে দিয়ে বলেন- "রাণীমা আপনার পায়ে রক্ত।"রক্ত দেখার জন্য মহারানী দাঁড়িয়ে পা দেখেন এবং কথামতো রাজপ্রাসাদে ফিরে আসেন । রাজা একটি দীঘি , বৃহৎদীঘি খনন করান। আর এই জন্যই দিঘিটির নাম হয় আলতাদিঘী। দিঘিটি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত।
আলতাদিঘীঃ- আলতাদিঘী নিয়ে জনশ্রুতি জনৈক রাজার মহারানী একটি দীঘি খননের কথা বলেন। তিনি যতদূর পায়ে হেটে যাবেন বিনা বিশ্রামে। ততো বড় দিঘি খনন করতে হবে । একদিন সকালে রানী হাঁটতে শুরু করলেন সৈন্য-সামন্ত পেছনে পেছনে অনেকটা পথ যাওয়ার পরও হেঁটে যাচ্ছেন ।এভাবে হেঁটে মাত্রাতিরিক্ত হলে দীঘি খননের রাজকোষ শূন্য হয়ে যাবে । তাই সৈন্যগণ মহারানীর অগোচরে পায়ে আলতা ছিটিয়ে দিয়ে বলেন- "রাণীমা আপনার পায়ে রক্ত।"রক্ত দেখার জন্য মহারানী দাঁড়িয়ে পা দেখেন এবং কথামতো রাজপ্রাসাদে ফিরে আসেন । রাজা একটি দীঘি , বৃহৎদীঘি খনন করান। আর এই জন্যই দিঘিটির নাম হয় আলতাদিঘী। দিঘিটি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত।
কিচকগড়ঃ- হরিরামপুর থেকে ইটাহার যাবার পথে দেহবন্দের কাছে একটি বড় ডিপি আছে। এটি কিচকগড় নামে পরিচিত। এখানে প্রাচীন ইটের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। জনশ্রুতি আছে এখানে বিরাট রাজার সেনাপতি কিচকের বাসভূমি ছিল। কিচকের বাসভূমির জন্যই এই জায়গাটির নাম হয়েছে কিচকগড়।
বাণগড়ঃ- গঙ্গারামপুর চৌরাস্তা থেকে একটু উত্তর দিকে গেলেই প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্র বাণ গড়। এটি ছিল প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন এর প্রাণকেন্দ্র। জনশ্রুতি আছে অসুররাজ বলি পুত্র বান এখানে রাজত্ব করতেন এবং তার নামেই এর নাম হয়েছে বাণগড়। প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক কুঞ্জ গোবিন্দ গোস্বামী এখানে খননকার্য চালান 1938 -41 খ্রিস্টাব্দে । খননকার্যে প্রাপ্ত সামগ্রী থেকে পাঁচটি যুগের অস্তিত্বের কথা বলেন। সেগুলি শুঙ্গ, মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন ও সুলতানি যুগ।
প্রস্তর স্তম্ভঃ- বাণগড় স্তুপের উত্তর-পূর্ব কোণে পাড়ার ভেতরে চারটি উঁচু পাথরের স্তম্ভ দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্থানীয় লোকেরা এই স্তম্ভ গুলিকে "কলাগাছ" বলে।জনশ্রুতি আছে এটি ছিল বান কন্যা ঊষা ও শ্রীকৃষ্ণ পৌত্র অনিরুদ্ধের বিয়ের ছায়া মন্ডপ।
কালদিঘি ও ধলদিঘিঃ- গঙ্গারামপুর শহরে দুটি বড় বড় দীঘি রয়েছে । জনশ্রুতি আছে, বাণ রাজার দুই রাণী কালো রাণীর স্নানের জন্য কালদিঘি ধলরাণীর নামে ধলদীঘি খনন করান। কাল দীঘির জল কালো আর ধল দীঘির জল সাদা।
আতা শাহের দরগাঃ- ধল দিঘির উত্তর পাড়ে মৌলানা আতা উল্লাহ বা আতা শাহ নামে জনৈক দরবেশ নানাস্থানে পরিভ্রমণ শেষে আস্তানা গাড়েন এবং আল্লাহ সমন্ধিয় জ্ঞান ও সৎ ত্যাগ ব্রতী জীবন-যাপন প্রভৃতি আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক মানুষই তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আতা শাহ জীবনের শেষ সময় টুকুও এখানেই অতিবাহিত করেন। কথিত আছে ,এই ধলদিঘির পাড়ে ছিল অতীতের বিখ্যাত দেবকোট বিহার । যা পাল রাজা ধর্মপাল এই বৌদ্ধ বিহারটি স্থাপন করেছিলেন।
সৈয়দ করম আলি টাটশাহী মাজারঃ- মৌলানা আতা শাহের মৃত্যুর বহু পরে ধল দিঘি দক্ষিণ পাড়ে সৈয়দ করম আলী টাট শাহী ফকির সাহেব আস্তানা করেন। সম্ভবত তিনি আতা শাহ এর অন্যতম সেবক ছিলেন। তিনিও আতা শাহ এর মতো অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ১২০৮ বঙ্গাব্দের ২৫ শে মাঘ সৈয়দ করম আলীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে উরস উৎসব শুরু হয় তাঁঁরই বংশধরের মাধ্যমে।
ঊষাতিটিঃ- বাণগড় থেকে পশ্চিম দিকে পুনর্ভবা নদীর পশ্চিম তীরে একটি উঁচু ঢিবি আছে। এটিকে ঊষাবন বা ঊষাতিটি বা ঊষাঢিবি বলে। এই ঢিবি সমতল ভূমি থেকে সাত-আট হাত উঁচু। সাধারণের ধারণা যে এইখানে মহাভারতে বর্ণিত বান রাজার কন্যা ঊষার ঘর ছিল। শ্রীকৃষ্ণ পৌত্র অনিরুদ্ধ ঊষাকে বিয়ে করে এখানে কিছুদিন ছিলেন। তিনি দারকা থেকে এই পর্যন্ত আসার জন্য গোপন সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করেছিলেন।
বখতিয়ার খিলজী সমাধিঃ- ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি নায়ক ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজী গৌড়- বরেন্দ্র আক্রমন করেন এবং লোখনৌতি সিংহাসন দখল করেন। এই নগর ধ্বংস করে রাজধানী স্থাপন করেন এবং দেবকোটে তার আধিপত্য বিস্তার করে সেনা নিবাস গড়েন। এখানে শক্তি শালী সেনাবাহিনী গঠন করে তিব্বতে অভিযান করেন। কিন্তু প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় এই অভিযান ব্যর্থ হয়। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে তিনি দেবকোটে ফিরে আসেন এবং অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। এই সুযোগে তার অন্যতম সেনা নায়ক আলি মর্দান তাকে হত্যা করেন। তাকে দেবকোটের কাছেই পীর পল গ্রামে সমাধি দেওয়া হয়।
মোগল সৈন্য সমাধিঃ- আলী মর্দান ছিলেন নারানকোই নামক স্থানের জায়গীরদার। কাল দীঘির পূর্ব দিকে বর্তমান নারই গ্রাম রয়েছে, তা ঐ নারানকোই নামেরই অপভ্রংশ হতে পারে। এই নারই গ্রামে মোগল সৈন্যের একটি সমাধি স্থল রয়েছে।
জৈন ধর্ম গুরু জম্বুস্বামীর সমাধিঃ- গঙ্গারামপুর থানার ফুলবাড়ি থেকে প্রাণ সাগর যেতে নিতপুর গ্রাম। সেখানে জৈন ধর্ম প্রচারক জম্বু স্বামীর সমাধিস্থল রয়েছে। জম্বু স্বামী ছিলেন মহাবীর এর পর তৃতীয় পূর্ণ জ্ঞানী। জৈনগুরু মহাবীর খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কোন ধর্ম প্রচারে এসে কোটিবর্ষ নগরের অধিবাসী সুদর্ণ স্বামীকে জৈন ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং সুদর্ণ স্বামী জম্বু স্বামীকে দীক্ষা দেন । জম্বু স্বামী নিগ্রধর্ম প্রচার করে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে দেবতার আসনে বসেন। এই অঞ্চলে তিনি দেহত্যাগ করেন এবং এখানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। জম্বু স্বামীর সমাধিস্থল জীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে কালের গ্রাসে বিলীন হবে বলে।
ফকিরগঞ্জ দরগাঃ- তিন/সাড়ে তিনশত বছর পূর্বে ফকিরগঞ্জ গ্রামে এক মুসলমান ফকিরের আবির্ভাব হয়। এখানে আস্তানা স্থাপন করে সাধনায় আত্ম নিয়োগ করেন। তিনি দেহ রাখার পর তাঁকে যে স্থানে সমাধি দেওয়া হয়, সেই স্থানটি কালক্রমে পীরের দরগা নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। যদিও তাঁর প্রকৃত পরিচয় অজ্ঞাত। এই পীরের প্রচেষ্টায় ফকির গঞ্জ হাইস্কুল ও অঞ্চলটি গ্রাম থেকে গঞ্জে পরিণত হয়। এই জন্যই গ্রামটির নাম ফকিরগঞ্জ হয়েছে।
বটুন সন্ধ্যাকর নন্দীর জন্মস্থানঃ-
কুমারগঞ্জ ব্লকের বটুন গ্রামের একটি ফাঁকা স্থানকে "রাম চরিত" গ্রন্থের রচয়িতা সন্ধ্যাকর নন্দীর জন্মভিটা বলে অনুমান করেন। বোতলের পূর্বতন নাম ছিল বৃহৎবটু। বরেন্দ্রভূমির পাল রাজা রামপালের সভাকবি ছিলেন সন্ধ্যাকর নন্দী। তার “রামচরিত” গ্রন্থে গৌড়- বরেন্দ্রির ইতিহাস আমরা জানতে পারি।
তপন দিঘিঃ- তপন থানার প্রাণ কেন্দ্রে 2 কিমি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এই দিঘিটি তপন দিঘি নামে পরিচিত।জনশ্রুতি আছে পুরাকালে শৈব উপাসক বাণ রাজা শিবের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতেন এই দিঘিতে । তর্পণ থেকে এই দিকের নাম তপন দীঘি ও গ্রামের নাম তপন হয়। এই দিঘির পাড়ে সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেন এর একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে । যা ইতিহাসে তর্পণ তাম্রশাসন নামে পরিচিত।দীঘির পশ্চিম পাড়ে উঁচু ঢিবি এবং ধ্বংসাবশেষ দেখে অনেকে অনুমান করেন সেন বংশের কোন স্থাপত্য ছিল। কালের গ্রাসে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে । লক্ষণ সেনের শিলালিপি প্রার্থীর নিরিখে অনুমান করা যায় যে দীঘিটি লক্ষণ সেন কর্তৃক খনন করা হয়ে থাকতে পারে। যা তার বংশপুরুষগণদের তর্পণ করতে খনন করেছিলেন।
বৌদ্ধ মঠ/দরগাঃ- বালুরঘাট ব্লকের কামালপুর গ্রামে একটি প্রাচীন স্থাপত্য রয়েছে। এটিকে কেউ বলেন দরকার আবার কেউ বলেন বৌদ্ধ মঠ।স্থাপত্যটির গঠনশৈলী দেখে সহজেই অনুমিত হয় এটি বৌদ্ধ মঠ।এর নির্মাণকাল এটি আসলে মঠ নাকি দরগা তা নিয়ে সাধারণের মধ্যে সংশয় আছে। প্রকৃতির নিয়মে এটি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ছোট খিদিরপুরঃ- বুনিয়াদপুর শহর থেকে দক্ষিণে এই গ্রামটি অবস্থিত । এখানে উদ্দিন সাহেবের ছোট নীলকুঠি ছিল। উইলিয়াম কেরি এটি কিনে নেন এবং বামনগোলা থানা মদনাবতী থেকে এখানে চলে আসেন। মুদ্রণ যন্ত্র সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এবং প্রথম বাংলা হরফে মুদ্রণ চালু করেন।
মহিপাল দিঘি ও নীল কুঠিঃ- কুশমন্ডি ব্লকের মহিপাল দিঘি অবস্থান। পাল রাজা প্রথম মহীপালের আমলে দীঘিটি খনন করা হয় । মহিপাল ও দিঘিকে নিয়ে নানা লোককথা প্রচলিত আছে। শোনাযায়,এই দীঘির পাড়ে বাংলার প্রথম সতীদাহ প্রথা চালু হয়েছিল। দৈর্ঘ্য 3800 ফুট এবং প্রস্থ 100 ফুট এই দিঘিটির আয়তন।
উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত এই দীঘির উত্তর পাড়ে একটি নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এই নীলকুঠি এতদাঞ্চলের সবচেয়ে বড় নীলকুঠি ছিল।
ঊষাহরণ রোড/সড়কঃ- উষাহরণ রোড নিয়ে পৌরাণিক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। বাণ কন্যা ঊষা ঊষাতিটিতে অবস্থানকালে শ্রীকৃষ্ণ পৌত্র অনিরুদ্ধ হরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন যে পথে তার নাম হয় ঊষাহরণ সড়ক বা রোড। বর্তমানে কুশমন্ডি চৌরাস্তা থেকে দক্ষিণ দিকের রাস্তাটি কে নির্ণয় করেছেন ইতিহাসবিদগণেরা ।এই পথে কিছুটা গেলে ঊষাহরণ নামে একটি গ্রামও দেখা যায়।
রামচন্দ্রপুরঃ- তপন ব্লকের রামচন্দ্রপুর একটি প্রাচীন গ্রাম। তপন থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এবং ভিকাহার থেকে চার কিমি পূর্বে অবস্থিত এই গ্রামটি। এই গ্রামের নামকরণ নিয়ে লোকমুখে শোনা যায় পূর্বে এখানে রামচন্দ্র নামে একজন রাজা ছিলেন। তার নামানুসারে এই গ্রামের নাম হয়েছে রামচন্দ্রপুর । এখনো গ্রামের একটি পতিতজমিকে স্থানীয়রা রামচন্দ্র রায়ের রাজবাড়ীর স্থান মনে করেন। গ্রামে অনেকগুলি প্রাচীন পুকুর আছে। এর মধ্যে "ঠাকুরাণ" পুকুরটি বেশ প্রাচীন এবং এর সাথে রামচন্দ্র রায়ের পরিবারের মৃত্যুর কিংবদন্তি জড়িয়ে আছে। একদিন রামচন্দ্র রায় স্বপ্নাদেশ পান শত্রু আক্রমণের,এই ভয়ে রাজা রামচন্দ্র স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ "ঠাকুরান" পুকুরে একটি নৌকায় আশ্রয় নেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবংশে ডুবে মারা যান। এই পুকুরের উত্তর দিকে রাম চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত শিবকালী মন্দির ছিল। কিছুকাল আগেও ধ্বংসাবশেষ দেখা গেলেও এখন আর কিছুই নেই।একটি প্রাচীন পাকুড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংসস্তুপের উপর মন্দিরের সাক্ষী হয়ে।
এমন অসংখ্য প্রাচীন মূর্তি এখনো নানাস্থানে খননকালে ভগ্ন-অভগ্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। তপনের চক বলিরাম এলাকায় খাঁড়ি সংস্কার কালে একটি বস্তার মধ্যে ভগ্ন শিব, মনসা ও শিবলিঙ্গ পাওয়া যায়। কিছু মূর্তি জেলার প্রাচ্যভারতী, সংগ্রহশালা ও কলেজ মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অসংখ্য ইতিহাস বিজড়িত অনেক স্থাপত্য সমাধি রয়েছে। বেশিরভাগ প্রাচীন মন্দির, মসজিদ বা দরগা সংরক্ষণ বা সংস্কারের অভাবে বিলুপ্ত হবার প্রহর গুনছে। তপন থানার করদহে মুশকিল আসান পীরের দরগা ও বুড়া পীরের দরগাও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অবিলম্বে প্রাচীন স্থাপত্য গুলো সংস্কার বা সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে অচিরেই হারিয়ে যাবে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রাচীন ইতিহাস।
ঋণস্বীকারঃ
১)পশ্চিমবঙ্গের পূজা পার্বণ ও মেলা-১ম খন্ড।অশোক মিত্র।
২) দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ঐতিহ্য ও স্বরূপ সন্ধান-ধনঞ্জয় রায়।
৩) আন্তর্জাল।
৪) সংবাদ পত্রঃ
উত্তরবঙ্গ সংবাদ
* ৫ই ডিসেম্বর ২০১৯
* ২৬শে এপ্রিল ২০১৯
* ৬ই মার্চ ২০১৯
* ১লা বৈশাখ ১৪২৫
*১৩ ই নভেম্বর ২০১৯
৫) ক্ষেত্র সমীক্ষাঃ খুশী সরকার। রণজিৎ কুমার সরকার। বিশু সিং। অনিমেষ ভট্টাচার্য।বিমল চক্রবর্তী।
৬) পুন্ড্রবর্ধন ও গৌড়-বরেন্দ্রী(দিনাজপুরের প্রাচীন ইতিহাস)-দেবব্রত মালাকার
শুভঙ্কর রায়
পোঃ করদহ,থানাঃ তপন
জেলাঃ দক্ষিণ দিনাজপুর
সূচক—৭৩৩১৪২
কথাঃ "9735069594
No comments:
Post a Comment