সূর্য পূজা ঃ দক্ষিণ দিনাজপুর।
শুভঙ্কর রায়
সূর্য পূজা বা সৌরধর্মের যে নিদর্শন আমরা প্রাচীনজ বাংলায় পাই , তার সাথে বেদের সূর্য দেবতার পূজার কোন সম্বন্ধ নেই । এটি প্রাচীন পারস্যের অগ্নি উপাসক, পুরোহিত সম্প্রদায় এবং আক্রমণকারী শক - কুশান শাসকগণ দ্বারা আনীত সূর্য পূজা । ভারতীয়রা তাদের অন্তর্নিহিত সমন্বয় প্রতিভার শক্তিতে একে আপন করে নিয়েছে এবং নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে রূপায়িত করেছে । ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রভাবে সূর্যের ধ্যান, প্রণাম প্রভৃতি সৃষ্টি হয়ে এটি এখন বাঙালির নিত্যপূজা ও নানাব্রতের অঙ্গীভূত হয়েছে ।
বাংলায় সূর্য পূজার জনপ্রিয়তার একটি প্রধান কারণ এই যে, দেব পূজার দ্বারা মনোবাঞ্ছা পূরণ ছাড়াও সূর্যের বিশেষ রোগ প্রশমন ক্ষমতা আছে বলে সাধারণের বিশ্বাস। অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলায় আদি গুপ্তযুগের প্রাপ্ত সূর্য মূর্তি বাংলার প্রাচীন সূর্য মূর্তির নিদর্শন বলে মনে করেন পণ্ডিতগণেরা। পাল যুগের ও অনেক সূর্য মূর্তি পাওয়া গেছে। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার হরিরামপুর থানার কসবা বৈরহাটা গ্রামের একটি আসিন সূর্য মূর্তি উল্লেখযোগ্য এই মূর্তির পাদদেশে লেখা আছে ,"সমস্ত রোগানাম হর্তা" । অর্থাৎ এই কথা অনুসারে বলা যায় সকল রোগের নিরাময় কারী দেবতা হলেন সূর্যদেবতা। সূর্যের আরোগ্যকারী শক্তি এই পূজার জনপ্রিয়তার একটি কারণ বলে মনে হয়।
গুপ্তা সম্রাটরা ‘পরম সৌর’ ছিলেন । আদি গুপ্তযুগের দুইটি সূর্য মূর্তি পাওয়া গেছে উত্তর বঙ্গে । বাংলার এই অংশ ছিল প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির অন্তর্গত এবং এখানে গুপ্তাধিপত্য নিরবচ্ছিন্নভাবে বহুদিন অব্যাহত ছিল। গুপ্ত সম্রাট কুমার গুপ্ত একটি সূর্য মন্দির নির্মাণ করেন। অনুমান করা যায় গুপ্ত যুগে সৌর ধর্ম প্রসার লাভ করেছিল এবং পাল ও সেন যুগে এর প্রতিপত্তি ক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
প্রাচীন যুগ থেকে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় সূর্য পূজার প্রচলন হয়েছে একথা প্রমাণিত। বর্তমান যুগের সূর্য ভক্তি বা পূজার রীতি সমানভাবে রয়েছে । ধর্মপ্রাণ মানুষেরা স্নান করে সূর্যদেবকে প্রাণভরে ভক্তি নিবেদন করেন। পূজা বা ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকলেও নতুন কোন সূর্য মূর্তি বা মন্দির স্থাপন লক্ষ্য করা যায় না। এই জেলার বিভিন্ন গ্রামের মেয়েরা যে সূর্য পূজা করে থাকে তা ঠিক স্থাপিত মূর্তিপূজা নয়। নিজেরা অস্থায়ী মূর্তি করে এবং পূজা শেষে জলে ভাসান নিজেরাই। মাঘ মাসের পঞ্চমী থেকে মাঘী পূর্ণিমা পর্যন্ত সূর্য পূজা পালন করা হয়। যারা সূর্য পূজা পালন করেন তাদের স্থানীয় ভাষায় ব্রতী বা বা বর্তি বলা হয় । গ্রামের কোন এক নির্দিষ্ট বাড়িতে ব্রতীরা একত্রিত হয়ে পুজা করেন । মূলত এটি মেয়েলি ব্রত। সূর্য পূজা সাধারণত রবিবার বা বৃহস্পতিবার করার নিয়ম। পূজার আগের দিন সকালে নদী বা পুকুর থেকে মাটি এনে সূর্য ঠাকুরের অবয়ব তৈরি করেন। বাড়ির উঠোনে লম্বা করে শোয়ানো মূর্তি তৈরী করেন । মূর্তিটি লম্বা অন্তত ৮ থেকে ১০ ফুট চওড়া ১ থেকে ২ ফুট এবং উচ্চতা ১/২ ফুট মত । আকৃতি নির্ভর করে প্রতি সংখ্যার উপর সংখ্যা যত বেশি হবে তত বড় হবে । বর্তীদের পূজার ঘট স্থাপনের জন্য মূর্তির দুপাশে বেদি তৈরি করা হয়। মূর্তিতে ফুলমালা দিয়ে সাজানো হয় । মাটির মূর্তি পূজা হলেও আকাশে উদীয়মান সূর্যের উদয় এবং অস্ত যাওয়ার নিরিখে পূজা হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ পূজার দিন সকালে সূর্যোদয়ের পূর্বে শক্ত হয়ে নিজেদের ঘরে পূর্বদিক হয় এবং পূজা সামগ্রী সাজিয়ে এক হাতে অন্য হাতে মাটির প্রদীপ নিয়ে সূর্য ঠাকুরের চারদিকে প্রদক্ষিণ করেন আকাশের দিকে তাকিয়ে । চারিপাশে ঘোরার সময় অনেকে সূর্য ঠাকুরকে নিয়ে ছড়া কাটেন,কেউ জয়ধ্বনি-উলুধ্বনি দেন সূর্যের ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য । এমনই একটি গ্রাম্য ছড়া —
"উঠো উঠো সূর্যাই, ঝিকিমিকি দিয়া
তোমারে পূজিবো আমি রক্ত জবা দিয়া
উঠো উঠো সূর্যাই রে, ঝিকিমিকি দিয়া ।
উঠিতে না পারি আমি হিমালির লাগিয়া।
উত্তর আলা কদম গাছটি দক্ষিণ আলা বাওরে।
গা তোল গা তোল সূর্যাই,ডাকে তোমার মাওরে।
শিয়রে চন্দনের বাটি বুকে ছিটা পড়েরে।
গা তোল গা তোল সূর্যাই ডাকে তোমার মাওরে ।"
যতক্ষণ সূর্য আকাশে সূর্য উদয় না হচ্ছে ততক্ষণ প্রদক্ষিণ করে এবং সূর্য দেখা দিলেই সূর্যকে প্রণাম করে নিজের নিজের ঘটের পাশে রেখে দেবে। পুরোহিত এসে পূজা করেন ।
পূজা শেষে কেউ কেউ নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আবার অনেকে গল্প-গুজব করে সারাদিন কাটিয়ে দেন। আবার সন্ধ্যে বেলা সূর্য অস্ত যাবার প্রাকমুহুর্তে সবাই হাজির হন এবং বিকেলে ঘট ও পূজার উপকরণ পশ্চিম দিক সাজানো হয় সকালের মতো করে সন্ধ্যাবেলা ঠাকুরকে প্রদক্ষিণ করে যতক্ষণ না সূর্য অস্ত যায়। সূর্য ডুবে গেলে পূজা পাট শেষ করে সবাই উপোস ভঙ্গ করেন। পরদিন মূর্তি ভেঙে নদী বা পুকুরে নিয়ে যায়।
মূলত রোগ ব্যাধি দূর পারিবারিক সুখ শান্তি ও নানারকম মনের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য মেয়েরা এই ব্রত করে থাকেন। বর্তমানে এই রীতি র পূজা খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না।
No comments:
Post a Comment