দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার লোকাচারঃপ্রসঙ্গ গো-ফাল্গুনি/গো-ফাগুনি
শুভঙ্কর রায়
প্রাচীন সভ্যতায় ধর্মভাব উদ্ভবের সময় প্রাকৃতিক শক্তিকে দেব - দেবী হিসেবে কল্পনা করে পুজাচারের সূচনা ঘটেছিল , প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য । তেমনি বন্য সভ্যতায় জীবজন্তুর সঙ্গে বসবাসের ফলে নানারকম জীবজন্তুর আক্রমণের ভীতি থেকে জীবজন্তুর পুজার বিশ্বাস জন্মে । ফলত জীবজন্তুর পুজার মূলে রয়েছে ভীতি মিশ্রিত শ্রদ্ধা । গরুকে মাতৃ রূপে কল্পনা করে তার পুজার প্রচলন শুধুমাত্র ভারতীয় নয়, মিশরীয় সভ্যতায়ও ছিল । সেখানে ভিন্ন জন্তুকে ভিন্ন দেবত্ব আরোপ করে বিভিন্ন নাম দিয়েছেন । গো - দেবতা ছিলো আয়িসিস । গো - দেবতার পুজা শুধু বাংলা বা ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর সবদেশেই প্রচলিত রয়েছে । গরু গ্রাম বাংলার এক অমূল্য প্রাণী সম্পদ । চাষের কাজে বলদ ব্যবহৃত হয় আর দুগ্ধবতী গাভী অর্থাৎ গাই গরুর দুধে খেয়ে - বেঁচে জীবনধারণ করে থাকে গ্রামীণ মানুষ । তাই গরুকে কেন্দ্র করে হিন্দু পরিবারে নানারকম আচার - অনুষ্ঠান ও সংস্কার রয়েছে । গো - ফাল্গুনি গরুকেন্দ্রিক একটি পুজাচার । ফাল্গুন মাসের সংক্রান্তিতে পূজা করা হয় বলে এই পূজার নাম হয়েছে গো - ফাল্গুনি । আর গো - ফাল্গুনি থেকে গো - ফাগুনি বা গো - ফাগুনা নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে হয় । ফাল্গুন মাসে গো - পুজার থেকে গো - ফাগুনি নাম হাওয়ার কারণ হতে পারে বা গো ইংরেজি শব্দের অর্থ যাওয়া তার সঙ্গে বাংলা মাস ফাল্গুন এ গো কেন্দ্রিক পুজাকে গো ফাল্গুনি বলে । সে যাইহোক ফাল্গুন মাসে গো - পুজার থেকে গো - ফাল্গুনি নামটি হাওয়ার পক্ষেই যুক্তিসংগত মনে হয় ।
মূলতঃ দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় যেসব গোষ্ঠী বা জাতি ও সম্প্রদায় বসবাস করছে ,তাদের বেশির ভাগ অংশই কৃষিজীবী। বহুকাল পূর্ব থেকেই কৃষি জেলার মূল ভিত্তি । প্রাচীন কালে দিনাজপুর পৌন্ড্রবর্দ্ধন জনপদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর এই জনপদ ইক্ষু চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল। এ কথা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। কৃষি কাজের সাথে গরুর সম্পর্ক নিগূঢ় । আর এই কৃষিকাজের জন্যই গবাদি পশুর যত্ন নেবার প্রয়োজনবোধ হয়েছে বহুকাল আগেই। প্রচন্ড শীত ,অতিবৃষ্টি ও গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহ থেকে রক্ষা পাবার জন্য মানুষ শুধু নিজের গৃহ নির্মাণ করেনি,গৃহপালিত পশু -পাখীর জন্যও আশ্রয়স্থান তৈরি করেছে। তাদের খাদ্য-পানীয়ের ব্যবস্থা করেছে। আর তাদের প্রতি কু-নজর বা খারাপ প্রভাব ও রোগব্যধি থেকে রক্ষা করতে শুরু করে গো-পুজা। এ থেকে বলা যায় পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো এতদা অঞ্চলে ও অতিপ্রাচীন কাল থেকেই গো-পুজার প্রচলন রয়েছে। তবে বিষহরি বা শিতলী পুজার মতো ব্যাপক প্রচলন ঘটেনি। এতদা অঞ্চলের গোফাগুনি পুজার অনুরূপ পুজাচার নিয়ে শিবতপন বসু তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের উত্তর পূর্বাঞ্চলের লোক সংস্কৃতি’
গবেষনা পত্রে উল্লেখ করেছেন—“পশ্চিম বাংলার উত্তর পূর্বাঞ্চলের বোড়ো ও মেচ উপজাতির মধ্যে চৈত্র সংক্রান্তিতে গো-পুজার প্রচলন রয়েছে। রাভা উপজাতির রাখাল সেবা গবাদি পশুর মঙ্গলার্থে অনুষ্ঠিত হয়। কার্তিক মাসে জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার জেলার চা-বাগিচা অঞ্চল সমূহে ওঁরাও,মুন্ডা,সাঁওতাল প্রভৃতির সোহরাই উৎসব প্রকৃতপক্ষে গো-দেবতার পুজা। ”
আবার লোকসংস্কৃতি গবেষক ওয়াকিল আহমেদ ‘বাংলা লোকসংস্কৃতি’ গ্রন্থে গো-পুজা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন —“হিন্দু বাঙালি গরুকে দেবতাজ্ঞানে পুজা করে। হিন্দু শাস্ত্রে গো-হত্যা মহাপাপ। গো-জাতি দেবকন্যা সুরভির সন্তান বলে ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে। ‘ঋগ্বেদে’ গরুর সঙ্গে পৃথিবীর অলৌকিক সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। ‘আবেস্তা’-য় এক দেবতার নাম হল ‘জিউস উর্বন’ যার অর্থ গরুর আত্মা । এতে গরুকে সমস্ত প্রাণীজগতের রক্ষক বলা হয়েছে। প্রাচীন মিশরে দুগ্ধবতী গাভী বা ‘হ্যাথর’ দেবতা জ্ঞানে পুজা পেত। ” এই তথ্য থেকে বোঝা যায় প্রাচীন কাল থেকেই গো-পুজার প্রচলন চলে আসছে।
গো-ফাল্গুনির দিন সকালে সব গরুকে গা ধুয়ে দেওয়া হয়। পাছনের পরিবর্তে বিষকাটালী (এক ধরনের বিষাক্ত গাছ , যা গুল্ম জাতীয় ) ও জলবন্যার (হিজল) ডাল দিয়ে গরুকে খেদিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। গরুর পায়ে ও কপালে আবির ও সিঁদুর , ধান ও দূর্বা দিয়ে পুজা দেওয়া হয়। গোয়াল বা খাটালের সামনে নানারকম কাটাযুক্ত গাছের ডাল পুরি ধোঁয়া দেওয়া হয়। গোয়াল ঘরে দরজার সামনে কচ্ছপের খোলস টাঙানোর নিয়মও দেখা যায় বৈশ্য কাপালী সমাজে । বিশ্বাস এতে কোনো কু-নজর লাগে না। মূলত এই আচারে গাছ-গাছড়ার প্রভাব জড়িয়ে আছে। লোক বিশ্বাস এতে গরুর রোগ প্রতিষেধকের কাজ করে। ইউরোপ মহাদেশের কৃষকরাও গরুর মঙ্গল কামনায় গাছের ডাল দিয়ে গরুকে খেদায়। ইংল্যাণ্ডেও এ আচার প্রচলিত আছে। ইংল্যাণ্ডের আচার সম্বন্ধে শরৎচন্দ্র মিত্রের লেখা উল্লেখ করা যেতে পারে — "Under the influence of the animistic belief,the uncultured folk throughout the British Islands regard the mountain -ash , rowantree, wicken-tree and whitty-tree in the right of protectives against witchcraft, and strick beast with a branch of anyone of the same , by doing which the believe that their cattle will remain hale and hearty."
এই পুজার জন্য কোনো পুরোহিত প্রয়োজন হয়না। গরুর মালিক বা গৃহকর্ত্রী এই পুজা করে থাকেন। গো-কেন্দ্রিক পুজাচার,যেমন গো-পুজা, গোয়াল পুজা, গোরক্ষনাথের পুজা,গরু উপলক্ষ্য এ ত্রিনাথ পুজা বা মেলা এবং পৌষ সংক্রান্তিতে গরুকে পিঠা খাওয়ানো,গরু চুমানি, এদের মধ্যে ত্রিনাথ পুজার পরেই গো-ফাগুনি বা গো-ফাল্গুনির আচারই বর্তমানে বেশি পরিলক্ষিত হয়। মানুষের মনের মধ্যে লোক বিশ্বাস যতদিন বজায় থাকবে এইসব পুজাচার ততদিন থাকবে।
শুভঙ্কর রায়
করদহ। তপন। দঃদিনাজপুর। ৭৩৩১৪২
৯৭৩৫০৬৯৫৯৪
Darun,anek kichu janlam
ReplyDelete