Wednesday, April 15, 2020

লোকাচার গাস্বী/গার্সী ব্রত


লোকাচার গাস্বী/গার্সি ব্রত
শুভঙ্কর রায়

"গাস্বীর রাত্রে আমরা যে গাছের ফল ধরে না, একটি কুড়াল লইয়া সেই গাছে দুই একটি কোপ দিতাম আর বলিতাম, এই গাছের ফল ধরে না, এই গাছ আজ কাটিয়া ফেলিব। আর একজন যাইয়া বলিত নানা কাটিস না এ বৎসর ফল ধরিবে। তখন নিরস্ত হইতাম। আমাদের বিশ্বাস ছিলো এরূপ করিলে গাছে ফল ধরিবে।"

পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের এই উক্তিতে বোঝা যায় বন্ধ্যা গাছে ফল ফলানোর জন্যই গাস্বি উৎসব পালন করা হয়। যদিও প্রথাটি নাটকীয় ভঙ্গিমাত্র। লৌকিক ক্রিয়ার মাধ্যমে গাছকে ভয় দেখিয়ে ফলবতী করার চেষ্টা স্বরূপ অভিনয় করা হয়। গাছের শুধু প্রাণ আছে তাই নয়। গাছের আত্মা আছে, বোধশক্তি আছে— এরূপ লোক বিশ্বাস এতে বিদ্যমান।

লোকসংস্কৃতিবিদ চিন্তাহরণ চক্রবর্তী মহাশয় হিন্দু কৃষক সমাজে আশ্বিন সংক্রান্তিতে পালিত অনুষ্ঠানকে গার্সি ব্রত বা গারুই ব্রতের উল্লেখ করেছেন, যার লক্ষ্য হলো গাছকে সাধ খাওয়ানো। আবার ডঃ অমলেন্দু মিত্র একই উদ্দেশ্যে গার্সে বা গাড়সেষষ্ঠী অনুষ্ঠান পালনর কথা বলেছম।  গার্সি বা গারসে উচ্চারণ ভেদে গাস্বী তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

গার্সী বা গাস্বীব্রত শব্দটি গাছকে সাধ খাওয়ানোর উৎসব অর্থে ব্যবহৃত হলেও এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আরো কিছু আচার-ব্যবহার পালন করা হয়।গাস্বীর ভোরে পরিবারের সকলের নামে একটি মাটির প্রদীপে আলাদা আলাদা সলতে জ্বালাতে হয়।  আর সেই প্রদীপ শিখার উষ্ণ তাপ মুখে- কপালে ঠেকাতে হয় । সেইসঙ্গে প্রদীপের তেল সারা গায়ে মাখাতে হয় । লোকবিশ্বাস এতে চর্ম জনিত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

আশ্বিন সংক্রান্তির সকালে নদীর বা পুকুর ঘাট থেকে কাঁদা মাটি এনে প্রয়োজনমতো প্রদীপ বানানো হয় এবং তা রোদে শুকানো হয়।  সন্ধের মধ্যে গাস্বীর প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড় করে মধ্য উঠোনে রাখা হয়।  কাঁচা হলুদ, হলুদের ফুল, কুমড়ো,একটি জল ভর্তি  ঘট, কলাপাতা সহ বিভিন্ন গাছের পাতা
ইত্যাদি।  জলভর্তি ঘটে সর্ষে  তেল দেওয়া হয়।  সমস্ত কিছু উঠানে জাগাতে হয়।  ভোরবেলা ঘরের যেখানে গৃহদেবতার আসন পাতা থাকে সেখানে বড় মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং পরিবারের সকল সদস্য সেই প্রদীপের শিখার তাপ এবং প্রদীপের তেল মাখিয়ে প্রণাম করে । তারপর বাড়ির উঠোনে, তুলসীতলা, গোয়ালঘর ,ফলের গাছের গোড়ায় ,ঘরের সামনে একটি করে প্রদীপ জ্বালায় । পরিবারের কোনো এক সদস্য ফলের গাছ গুলোতে খড়ের দঁড়ি বেঁধে দেয় এবং দাঁ দিয়ে এক কোপে একটু ছাল তুলে দেয়।  বাড়ির মহিলারা রাত জাগানো ওষধি গাছের পাতা , কাঁচা হলুদ ,সর্ষে বেটে রাখে।  সেই বাটা গায়ে মাখিয়ে সকালবেলা স্নান করে এবং ঘটের জল দেওয়া যে সরষের তেল দেওয়া ছিল তা সারা গায়ে মাখায়।সেদিন কেউ সাবান বা গায়ে মাখার অন্যান্য দ্রব্য ব্যবহার করেন না । ঘটের মধ্যে তেল চাকার মত আকার ধারণ করে । সেগুলো দেখে অনুমিত হয় সারা বছর আর্থিক অবস্থা কেমন যাবে । ভোরবেলা গাছ কাটার দাঁ দিয়ে কুমড়ো বলি দেওয়া হয় । পাটকাঠি দিয়ে ঘরদোর সর্প দোষ কাটানো হয় আর ছড়া কাটেন—। “সাপিলো কুপি লো,ঘর থেকে  বাইরে যা” বিশ্বাস গাস্বীর রাতে এই নিয়ম করলে ঘরের মধ্যে সাপ,পোঁকা-মাকড় ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । বৈশ্য কাপালী সমাজে এই রূপ রীতি পালন করা হয় । লোকবিশ্বাস এইসব নিয়ম করলে চর্মরোগ সহ অসুখ-বিসুখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং সংসারের বিপদ আপদ দূর হয়।

চিন্তাহরণ চক্রবর্তী গার্সী উৎসবকে ফলবতী গাছকে সাধ খাওয়ানোর কথা বলেছেন। আবার ডঃ অমলেন্দু মিত্রও সাধ খাওয়ানোর কথায় সম্মতি জানিয়ে বলেছেন —“নানা স্থানে আশ্বিনের সংক্রান্তিতে গার্সী বা গারুব্রত বা গারুই অনুষ্ঠিত হয় । অনেক স্থানে ইহা ধান গাছকে সাধ খাওয়নোর উৎসব।  চাষিরা প্রত্যুষে কাঁচা হলুদ বাটার সাথে সরিষার তেল মিশাইয়া ধানের ক্ষেতে ছিটাইয়া দিয়া বলে “ধান এর সাধ খা, পাকা ফুল্ল্যা ঘরে যা। ” মূলত এখানে বোঝা গেল গর্ভবতী নারীর মতো কে সাথ দেওয়ার রীতি যেহেতু ঋতুবতী নারী , শস্যবতী খেত বা ফলবতি বৃক্ষ প্রজনন বা উৎপাদনের দিক দিয়ে একই । তাই ভালো ফসলের কামনায় গৃহস্থরা শস্যসম্ভবা খেত বা বৃক্ষকে সাধ দেয়।  বাঙালির প্রধান খাদ্য ফসল ধান।  বর্ষাকালে ধান রোপন করে ভাদ্র- আশ্বিনে ধনের গর্ভ হয় অর্থাৎ শিস দেখা দেয়, অগ্রহায়ণে আমন ধান কাটা হয় । আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির পূর্বে একমাত্র বর্ষাকালীন ধান চাষই ছিল নির্ভরশীল । তাই এই ধান শষ্যকেই সাধ দেওয়ার রীতি চালু হয়েছিল।

আবার কোনো কোনো গবেষক গার্সীব্রত উপলক্ষে বলেছেন —“বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনে দেশীয় সংস্কৃতি এখন জাদুঘরে ঢুকছে।  বিভিন্ন ধরনের খাবার ভিত্তিক উৎসবের কথা লিখে শেষ করা যাবে না । বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে অনেক উৎসব ছিলো।  যেমন গার্সী নামে একটি উৎসব ছিল । এখন আর এসবের বালাই নেই । গার্সী উৎসবে ভাদ্র মাসের শেষ দিনে রান্না করা খাবার পরের মাসের শুরুর দিকে খাওয়া হতো । তালশাঁস কে ঘিরে একটি উৎসব বাংলায় হতো এটা আর কয়েকবছর পরে হয়তো কেউ বিশ্বাসই করবে না। ” উৎসব নিয়ে এই বক্তব্যটি একটু ভিন্নমত লক্ষ্য করা গেলেও উক্ত অনুষ্ঠানকে কাপালী সম্প্রদায়ের মানুষেরা ‘পান্নার ভাত’ অনুষ্ঠান বলে থাকে এবং নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের লোকেরা একেই ‘গ্যাসী’ বা ‘গার্সী’ বলে।  যদিও অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য গৃহস্থের মঙ্গল কামনা । সম্প্রদায়গত ভিন্নতার জন্য আচরণগত ভিন্নতা অবশ্যম্ভাবী এবং ভিন্ন সম্প্রদায়গত কারণে ভাষাগত পরিবর্তনও কিছু অস্বাভাবিক নয়।  কিন্তু আশ্বিনের সংক্রান্তি উপলক্ষে কাপালি সমাজে তালের  আঁটির যে শাঁস হয় তা কেটে পরিবারের সকলে খেয়ে থাকে।  কিন্তু এর কোনো কারণ আছে বলে মনে হয়না।

এই উৎসবে কোন পুরোহিত প্রয়োজন হয়না।  গৃহস্থ বাড়ির লোকেরাই করে থাকে । কোন ফল আহারের প্রয়োজন নেই । আগের মত এখন আর তেমন জৌলুস না থাকলেও এর নিয়ম হয়ে চলেছে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে।

ঋণ স্বীকার
বাংলার লোকসংস্কৃতি - ওয়াকিল আহমেদ।
নরেশ ভৌমিক , বিমল চক্রবর্তী, সুপ্রিয়া খাঁ। —করদহ,দঃদিনাজপুর। 

পরিচিতি।।।
শুভঙ্কর রায়
গ্রামঃ নওগাঁ পদপাড়া
পোঃ করদহ, তপন,
দক্ষিণ দিনাজপুর। 
সূচক_৭৩৩১৪২
কথাঃ৯৭৩৫০৬৯৫৯৪

No comments:

Post a Comment

দিনাজপুর জেলার ইতিহাস অনুসন্ধান দ্বিতীয় খণ্ড

দিনাজপুর জেলার ইতিহাস অনুসন্ধান ( দ্বিতীয় খণ্ড ) দিনাজপুর জেলার ইতিহাস অনুসন্ধান দ্বিতীয় খন্ড  প্রকাশক : চক্রবর্তী এন্ড সন্স পাবলিকেশন  সম...