বৈরহাট্টার বুড়িমেলা
শুভঙ্কর রায়
বাঙালির লৌকিক ও জনপ্রিয় উৎসব মেলা। মূলত গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে মেলার উৎপত্তি। তবে কবে, কিভাবে মেলার উৎপত্তি তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন। বিশেষ কোন পরব বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই মেলার প্রচলন হয়েছে। মেলার আক্ষরিক অর্থ মিলন।মেলা-ই পারে অজানা - অচেনা মানুষদের একত্রিত করতে, ভাব বিনিময়ের সুযোগ করে দিতে। কবি অতুলপ্রসাদ সেন বলেছেন-
"নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান,
বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান।"
কবি ঠিকই বলেছেন।মানুষের ভাষা, মত , পোশাক-আষাক ভিন্ন হলেও উৎসব ও মেলাই পারে সকলকে এক মঞ্চে হাজির করতে । মেলা মানেই মিলনক্ষেত্র। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম হলো মেলা। মানুষের ব্যস্ত জীবন ও একঘেয়েমি জীবন যাপনে আনন্দ বয়ে আনে মেলা। মেলায় নানা শ্রেণীর মানুষের সমাগম ঘটে, মানুষে - মানুষে এবং শিল্পী ও শিল্পের সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে।
উত্তরবঙ্গে মূলত ধর্মীয় উৎসব, পূজা-পার্বণকে কেন্দ্র করে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলা ও উৎসব একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। পূজা- উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলা বসে আর মেলা-ই পূজা উৎসবের পূর্ণতা আনে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় অনেক প্রাচীন মেলা ও উৎসব। নানা রকম পরিস্থিতির মধ্যে কোনটি বন্ধ হয়ে গেছে , আবার কোনোটি টিকে রয়েছে।তেমনই একটি প্রাচীণ মেলা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার হরিরামপুর ব্লকের বৈরহাট্টার বুড়ি মেলা।
বৈরহাট্টার বুড়িকালী পুজা ও পুজা উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মেলা দুশো বছরের পুরোনো।প্রথমে গড়দিঘীর পাড়ে জঙ্গলঘেরা ফুলতলা নামক স্থানে পুজা শুরু হলেও পরে সরিয়ে আনা হয় বৈরহাট্টা এলাকায়।মন্দিরে কোন মূর্তি নেই।পরিবর্তে রয়েছে কাঠের তৈরী বুড়াবুড়ির মুখোস।বুড়াবুড়ি এখানে চন্ডী বা দূর্গা হিসেবে মান্যতা পান। প্রতি বৎসর কার্তিক মাসে যেকোন বুধবার পুজা আরম্ভ হয় এবং তিনদিন পর্যন্ত এই উৎসব চলে।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অন্যতম লৌকিক দেবী বুড়িমা। বট বা অশ্বত্থ গাছের নিচে চালাঘরে বুড়িমার মূর্তি দেখা যায়। গায়ের রঙ ফ্যাকাসে হলুদ, মাথায় সাদা চুল, পরনে সাদা শাড়ি। জেলার বিভিন্ন স্থানে বুড়ি মার পুজো হলেও বৈরহাট্টা গ্রামে বুড়িমার পাকা মন্দির নির্মিত হয়েছে এবং এখানে মন্দিরে কোনও মূর্তি নেই। কাঠের তৈরি মুখা বুড়ি কালী রূপে পূজা হয়। এই বুড়িমা পুজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মুখা নাচ। বুড়াবুড়ি, উড়নকালী, মাসনা, চামুণ্ডা ইত্যাদি মুখা গুলি দেবাংশীর হাতের মন্ত্রপূত জলে যেন প্রাণ পায়। মেলার শেষ দিন অর্থাৎ তৃতীয় দিন ভক্তরা একত্রিত হয়ে মুখা নিয়ে তান্ডব নৃত্য করেন। মুখোশ নিয়ে সিঁদুর মাখানো খড়গ হাতে উৎসব প্রাঙ্গণে ঢাকের তালে উদ্যম নিত্য করে। প্রথমে গোল হয়ে নৃত্য শুরু করলেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে মেলা চত্বরে। নাচের দলের যার হাতে খড়গ থাকে, তার মধ্যে দেবী মাতা ভর করেন। স্থানীয় ভাষায় একে পাতা পড়া বলে। পাতা পড়া ব্যক্তির চেহারা ভয়ঙ্কর হয়ে যায়। নানাভাবে মিনতি স্তুতি করে উদ্যম নৃত্য থামাতে হয়। সে নৃত্য প্রবল ভয়ংকর। ভর পড়া ব্যক্তিটিকে সবাই বুড়িকালী মনে করেন। ভক্তরা কাতর স্বরে নানা সমস্যার কথা জানান এবং বুড়িকালী মা ভর করা ব্যক্তির মুখ দিয়ে সমাধানের পথ বলে দেন। মানুষের যেমন ভয় করেন আবার ভক্তিভরে বিশ্বাসও করেন। এই বিশ্বাসের ফল ভক্তরা পান। তাই বৈরহাট্টার বুড়িকালী খুব জাগ্রত দেবী বলে প্রচলীত।
পূর্বে চালা যুক্ত ঘরে মায়ের আসন থাকলেও বর্তমানে ইস্টক নির্মিত মন্দির স্থাপন করা হয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণে বহু দূর দূরান্ত থেকে অগণিত ভক্ত সমাগম যেমন ঘটে তেমনি দোকানপাটও আসে ।শুধু মনিহারী বা খাবার-দাবারের দোকান নয় ।কাঠের আসবাবপত্র, খেলনা, জামা কাপড়ের দোকান, জিলিপি পাপড় ভাজা এবং বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী পসরা সাজিয়ে বসে মেলাকে প্রাণবন্ত করে তোলে ।এছাড়া পুতুলনাচ, চিত্রহার, নাগরদোলা, সার্কাস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।
তিনদিন ধরে চলা মেলায় বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সমাগমে ও দোকান পাটের ভিড়ে আনন্দ উদ্দীপনায় ভরে উঠে মেলা প্রাঙ্গণ।
No comments:
Post a Comment