Wednesday, April 15, 2020

লোকাচার গাস্বী/গার্সী ব্রত


লোকাচার গাস্বী/গার্সি ব্রত
শুভঙ্কর রায়

"গাস্বীর রাত্রে আমরা যে গাছের ফল ধরে না, একটি কুড়াল লইয়া সেই গাছে দুই একটি কোপ দিতাম আর বলিতাম, এই গাছের ফল ধরে না, এই গাছ আজ কাটিয়া ফেলিব। আর একজন যাইয়া বলিত নানা কাটিস না এ বৎসর ফল ধরিবে। তখন নিরস্ত হইতাম। আমাদের বিশ্বাস ছিলো এরূপ করিলে গাছে ফল ধরিবে।"

পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের এই উক্তিতে বোঝা যায় বন্ধ্যা গাছে ফল ফলানোর জন্যই গাস্বি উৎসব পালন করা হয়। যদিও প্রথাটি নাটকীয় ভঙ্গিমাত্র। লৌকিক ক্রিয়ার মাধ্যমে গাছকে ভয় দেখিয়ে ফলবতী করার চেষ্টা স্বরূপ অভিনয় করা হয়। গাছের শুধু প্রাণ আছে তাই নয়। গাছের আত্মা আছে, বোধশক্তি আছে— এরূপ লোক বিশ্বাস এতে বিদ্যমান।

লোকসংস্কৃতিবিদ চিন্তাহরণ চক্রবর্তী মহাশয় হিন্দু কৃষক সমাজে আশ্বিন সংক্রান্তিতে পালিত অনুষ্ঠানকে গার্সি ব্রত বা গারুই ব্রতের উল্লেখ করেছেন, যার লক্ষ্য হলো গাছকে সাধ খাওয়ানো। আবার ডঃ অমলেন্দু মিত্র একই উদ্দেশ্যে গার্সে বা গাড়সেষষ্ঠী অনুষ্ঠান পালনর কথা বলেছম।  গার্সি বা গারসে উচ্চারণ ভেদে গাস্বী তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

গার্সী বা গাস্বীব্রত শব্দটি গাছকে সাধ খাওয়ানোর উৎসব অর্থে ব্যবহৃত হলেও এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আরো কিছু আচার-ব্যবহার পালন করা হয়।গাস্বীর ভোরে পরিবারের সকলের নামে একটি মাটির প্রদীপে আলাদা আলাদা সলতে জ্বালাতে হয়।  আর সেই প্রদীপ শিখার উষ্ণ তাপ মুখে- কপালে ঠেকাতে হয় । সেইসঙ্গে প্রদীপের তেল সারা গায়ে মাখাতে হয় । লোকবিশ্বাস এতে চর্ম জনিত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

আশ্বিন সংক্রান্তির সকালে নদীর বা পুকুর ঘাট থেকে কাঁদা মাটি এনে প্রয়োজনমতো প্রদীপ বানানো হয় এবং তা রোদে শুকানো হয়।  সন্ধের মধ্যে গাস্বীর প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড় করে মধ্য উঠোনে রাখা হয়।  কাঁচা হলুদ, হলুদের ফুল, কুমড়ো,একটি জল ভর্তি  ঘট, কলাপাতা সহ বিভিন্ন গাছের পাতা
ইত্যাদি।  জলভর্তি ঘটে সর্ষে  তেল দেওয়া হয়।  সমস্ত কিছু উঠানে জাগাতে হয়।  ভোরবেলা ঘরের যেখানে গৃহদেবতার আসন পাতা থাকে সেখানে বড় মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং পরিবারের সকল সদস্য সেই প্রদীপের শিখার তাপ এবং প্রদীপের তেল মাখিয়ে প্রণাম করে । তারপর বাড়ির উঠোনে, তুলসীতলা, গোয়ালঘর ,ফলের গাছের গোড়ায় ,ঘরের সামনে একটি করে প্রদীপ জ্বালায় । পরিবারের কোনো এক সদস্য ফলের গাছ গুলোতে খড়ের দঁড়ি বেঁধে দেয় এবং দাঁ দিয়ে এক কোপে একটু ছাল তুলে দেয়।  বাড়ির মহিলারা রাত জাগানো ওষধি গাছের পাতা , কাঁচা হলুদ ,সর্ষে বেটে রাখে।  সেই বাটা গায়ে মাখিয়ে সকালবেলা স্নান করে এবং ঘটের জল দেওয়া যে সরষের তেল দেওয়া ছিল তা সারা গায়ে মাখায়।সেদিন কেউ সাবান বা গায়ে মাখার অন্যান্য দ্রব্য ব্যবহার করেন না । ঘটের মধ্যে তেল চাকার মত আকার ধারণ করে । সেগুলো দেখে অনুমিত হয় সারা বছর আর্থিক অবস্থা কেমন যাবে । ভোরবেলা গাছ কাটার দাঁ দিয়ে কুমড়ো বলি দেওয়া হয় । পাটকাঠি দিয়ে ঘরদোর সর্প দোষ কাটানো হয় আর ছড়া কাটেন—। “সাপিলো কুপি লো,ঘর থেকে  বাইরে যা” বিশ্বাস গাস্বীর রাতে এই নিয়ম করলে ঘরের মধ্যে সাপ,পোঁকা-মাকড় ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । বৈশ্য কাপালী সমাজে এই রূপ রীতি পালন করা হয় । লোকবিশ্বাস এইসব নিয়ম করলে চর্মরোগ সহ অসুখ-বিসুখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং সংসারের বিপদ আপদ দূর হয়।

চিন্তাহরণ চক্রবর্তী গার্সী উৎসবকে ফলবতী গাছকে সাধ খাওয়ানোর কথা বলেছেন। আবার ডঃ অমলেন্দু মিত্রও সাধ খাওয়ানোর কথায় সম্মতি জানিয়ে বলেছেন —“নানা স্থানে আশ্বিনের সংক্রান্তিতে গার্সী বা গারুব্রত বা গারুই অনুষ্ঠিত হয় । অনেক স্থানে ইহা ধান গাছকে সাধ খাওয়নোর উৎসব।  চাষিরা প্রত্যুষে কাঁচা হলুদ বাটার সাথে সরিষার তেল মিশাইয়া ধানের ক্ষেতে ছিটাইয়া দিয়া বলে “ধান এর সাধ খা, পাকা ফুল্ল্যা ঘরে যা। ” মূলত এখানে বোঝা গেল গর্ভবতী নারীর মতো কে সাথ দেওয়ার রীতি যেহেতু ঋতুবতী নারী , শস্যবতী খেত বা ফলবতি বৃক্ষ প্রজনন বা উৎপাদনের দিক দিয়ে একই । তাই ভালো ফসলের কামনায় গৃহস্থরা শস্যসম্ভবা খেত বা বৃক্ষকে সাধ দেয়।  বাঙালির প্রধান খাদ্য ফসল ধান।  বর্ষাকালে ধান রোপন করে ভাদ্র- আশ্বিনে ধনের গর্ভ হয় অর্থাৎ শিস দেখা দেয়, অগ্রহায়ণে আমন ধান কাটা হয় । আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির পূর্বে একমাত্র বর্ষাকালীন ধান চাষই ছিল নির্ভরশীল । তাই এই ধান শষ্যকেই সাধ দেওয়ার রীতি চালু হয়েছিল।

আবার কোনো কোনো গবেষক গার্সীব্রত উপলক্ষে বলেছেন —“বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনে দেশীয় সংস্কৃতি এখন জাদুঘরে ঢুকছে।  বিভিন্ন ধরনের খাবার ভিত্তিক উৎসবের কথা লিখে শেষ করা যাবে না । বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে অনেক উৎসব ছিলো।  যেমন গার্সী নামে একটি উৎসব ছিল । এখন আর এসবের বালাই নেই । গার্সী উৎসবে ভাদ্র মাসের শেষ দিনে রান্না করা খাবার পরের মাসের শুরুর দিকে খাওয়া হতো । তালশাঁস কে ঘিরে একটি উৎসব বাংলায় হতো এটা আর কয়েকবছর পরে হয়তো কেউ বিশ্বাসই করবে না। ” উৎসব নিয়ে এই বক্তব্যটি একটু ভিন্নমত লক্ষ্য করা গেলেও উক্ত অনুষ্ঠানকে কাপালী সম্প্রদায়ের মানুষেরা ‘পান্নার ভাত’ অনুষ্ঠান বলে থাকে এবং নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের লোকেরা একেই ‘গ্যাসী’ বা ‘গার্সী’ বলে।  যদিও অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য গৃহস্থের মঙ্গল কামনা । সম্প্রদায়গত ভিন্নতার জন্য আচরণগত ভিন্নতা অবশ্যম্ভাবী এবং ভিন্ন সম্প্রদায়গত কারণে ভাষাগত পরিবর্তনও কিছু অস্বাভাবিক নয়।  কিন্তু আশ্বিনের সংক্রান্তি উপলক্ষে কাপালি সমাজে তালের  আঁটির যে শাঁস হয় তা কেটে পরিবারের সকলে খেয়ে থাকে।  কিন্তু এর কোনো কারণ আছে বলে মনে হয়না।

এই উৎসবে কোন পুরোহিত প্রয়োজন হয়না।  গৃহস্থ বাড়ির লোকেরাই করে থাকে । কোন ফল আহারের প্রয়োজন নেই । আগের মত এখন আর তেমন জৌলুস না থাকলেও এর নিয়ম হয়ে চলেছে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে।

ঋণ স্বীকার
বাংলার লোকসংস্কৃতি - ওয়াকিল আহমেদ।
নরেশ ভৌমিক , বিমল চক্রবর্তী, সুপ্রিয়া খাঁ। —করদহ,দঃদিনাজপুর। 

পরিচিতি।।।
শুভঙ্কর রায়
গ্রামঃ নওগাঁ পদপাড়া
পোঃ করদহ, তপন,
দক্ষিণ দিনাজপুর। 
সূচক_৭৩৩১৪২
কথাঃ৯৭৩৫০৬৯৫৯৪

পুনর্ভবা নদীর তীরে বারুণী মেলা

পুনর্ভবা নদীর তীরে বারুণী মেলা
শুভঙ্কর রায়

সামাজিক জীবনযাত্রায় মেলার বিকল্প হিসেবে যদি কিছু থাকে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মেলা নিজেই।কখনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কখনো আবার লোকাচারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মেলার প্রাণকেন্দ্র।
 আর উৎসব প্রাঙ্গণ মানুষে মানুষে মহামিলনের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। গ্রাম বাংলার ঋতু কেন্দ্রিক, সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবকে বিদ্বজ্জনেরা একটি প্রবাদে আবদ্ধ করেছেন,-"বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ"। আবার কবির ভাষায় বলা যায়-"এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবু রঙ্গে ভরা"। উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতির নদীকেন্দ্রিক একটি উৎসব বারুণী স্নান উৎসব। চৈত্র মাসের কৃষ্ণ ত্রয়োদশী তিথিতে শতভিষা নক্ষত্র যোগে হয় বারুণী স্নান। বরুণের কন্না বারুণী। বরুণ হলেন জলের দেবতা। আবার গঙ্গার অপর নাম বারুণী। আমরা জানি গঙ্গা পূণ্যদায়িনী, পাপনাশিনী। তাই আমরা পূর্ণ লাভের আশায় গঙ্গা স্নান করে থাকি। এছাড়াও বাঙালীর পূজা-পার্বণে গঙ্গাজল, গঙ্গা মাটি অবশ্য প্রয়োজনীয়।'গঙ্গা গঙ্গা'উচ্চারণ করে গঙ্গায় স্নান করলে সকল পাপ ধুয়ে যায়। বারুনী স্নান গঙ্গাস্নানের প্রতিরূপ। বারুণী স্নান বস্তুত হিন্দু ধর্মীয় একটি পুণ্যস্নান উৎসব।

গঙ্গা পূজা ভিন্ন সময় ভিন্ন মাসে হয়ে থাকে। তারমধ্যে উল্লেখ্য মকর সংক্রান্তিতে (পৌষ সংক্রান্তি) মকর স্নান, দোল পূর্ণিমার ১৩ দিন পর অর্থাৎ চৈত্র কৃষ্ণ ত্রয়োদশী তিথিতে বারুণী স্নান, জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে গঙ্গাদশোহরা বা গঙ্গা দেবীর পূজা।

মর্তে  গঙ্গা পূজা প্রচলন সম্বন্ধে পুরাণে বর্ণিত আছে সগর বংশের রাজা ভগিরথ পূর্বপুরুষদের উদ্ধার করার জন্য স্বর্গ থেকে গঙ্গা দেবী কে মর্তে নিয়ে আসেন।সগর রাজার ষাট হাজার সন্তানের মধ্যে দুইজন ভাল বাকিরা দস্যু প্রকৃতির ছিল। তাদের কপিলমুনি শাপ দিয়ে ভষ্মীভূত করেন। তাদের উদ্ধারের জন্য সগর বংশের উত্তরসূরিরা বিধান খোঁজেন। কপিলমুনি বিধান দেন "গঙ্গাকে মর্তে এনে পূজা দিলে উদ্ধার হবে"। তিন পুরুষ ধ্যান  তপস্যা করতে করতে দেহ রাখেন এবং রাজা ভগিরথ তপস্যায় দেবতাকে তুষ্ট করে গঙ্গাকে মর্তে আনতে সক্ষম হন ‌। পূণ্যদায়িনী, স্রোতস্বিনী গঙ্গা মর্তে আগমনকালে স্রোতের তোড়ে জাঙ্ঘমুনির যজ্ঞস্থল ভাসিয়ে নেয়। জাঙ্ঘমুনি ক্রুদ্ধ হয়ে গঙ্গার ফল্গুধারা নিজ দেহে ধারণ করেন। ভগিরথের অনুনয় প্রার্থনায় গঙ্গার ধারা কর্ণ দিয়ে বের করে দেন। জাঙ্ঘমুনির কর্ণ দিয়ে পুনর্জন্ম হওয়ায় গঙ্গার অপর নাম জাঙ্ঘবী।গঙ্গার প্রবল বেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য দেবাদিদেব মহাদেব মস্তকে ধারণ করেন।

লোকবিশ্বাস যে বারুণী স্নানের দিন বাংলার সব নদীই গঙ্গার মত পবিত্রতা লাভ করে। এই তিথিতে যে কোন নদীতে স্নান করলে সমান পূণ্য লাভ হয়। সেই সূত্রে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বুক চিরে বয়ে চলা পুনর্ভবা নদীও গঙ্গার মত পবিত্র হয়ে ওঠে। পুনর্ভবা নদী সম্বন্ধে কবি সন্ধ্যাকর নন্দী'রামচরিত' গ্রন্থে বরেন্দ্রভূমির সীমারেখা বর্ণনায় বলেছেন-"পশ্চিমে গঙ্গা ও পূর্বে করতোয়া নদী দ্বয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলই ছিল বরেন্দ্রভূমি। আর এই দুই নদীর মধ্যবর্তী স্থানে প্রসিদ্ধ অপূর্নভবা ঘাট বা অবতরণ ঘাট ছিল। দুই নদীর মধ্যবর্তী স্থানে পুনর্ভবা নদীর তীরে শোণিতপুর (বাণগড়) ছিল গৌড়ের রাজধানী রামাবতীর পূর্ব সময় পর্যন্ত। কালের পরিবর্তনের সাথে অপূর্ণভবা পুনর্ভবা নামে পরিচিতি লাভ করে।" সূত্র ধরে বলা যায় পুনর্ভবাও গঙ্গার মতো পবিত্র আর এখানে স্থান করলে পুণ্যার্জন হয়।

পুনর্ভবা বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলার অবনমিত নিম্নভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর-তপন ব্লকের বুক চিরে মালদহ জেলা হয়ে বাংলাদেশের নবাবগঞ্জ জেলায় মহানন্দা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। দুই বাংলা মিলিয়ে পুনর্ভবার মোট দৈর্ঘ্য১৬০ কিমি,তার মধ্যে যতটুকু অংশ দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে। এইটুকু অংশে মোট পাঁচ জায়গায় বারুণী স্নান উৎসব মেলার আয়োজন হয়।

শিববাড়ি, তপন থানার বাসুরিয়া, আমতলী ঘাট, গোলাবাড়ি ঘাট, নওগাঁ - করদহ ঘাট। এইস্থানগুলোর মধ্যে গঙ্গারামপুর ব্লকের বাণগড়ের অনতিদূরে শিববাড়ি বারুণী উৎসব সবচেয়ে প্রাচীন।লোকমুখে শোনা যায় যে শিববাড়ির জমিদারদের একসময় এই মেলায় সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ভক্তরা পুনর্ভবা নদীতে গঙ্গা স্নান করে শিবের মাথায় (বাণেশ্বর ধাম) জল ঢেলে,গঙ্গার মূর্তিতে পুজো দিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে মেলার আনন্দ উপভোগ করে বাড়ি ফিরত।এখানে ঠিক কবে থেকে গঙ্গা বা বারুণী স্নান উৎসব মেলা শুরু হয়েছিল তার সঠিক তথ্য মেলা ভার। তবে সন্ধ্যাকর নন্দীর তথ্য থেকে অনুমান করা যায় পৌরাণিক যুগ থেকে এখানে স্নান করে মানুষজন পূণ্যার্জন বা অপূর্ণতা ত্যাগের ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে পূর্ণতা লাভ করতেন। সেই থেকে সহজেই অনুমিত হয় গঙ্গাস্নানের ঘাট হিসেবে বহুকাল প্রাচীন।

প্রাচীন অর্থের দিক থেকে বাসুরিয়া বারুণী মেলাও বেশ প্রাচীন। মেলায় প্রচুর দোকানপাট, মনোরঞ্জন মূলক ব্যবস্থা , খাবার-দাবারের দোকান এবং আসবাবপত্রের দোকান বসত। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ভিড় জমাতো।সকাল থেকে নদীর ঘাটে বহু ভক্তের সমাগম এবং বারুণী স্নান সম্পন্ন করে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে ফল, ফুল, বেলপাতা, ডাব নিবেদন করে ধুপ জ্বালিয়ে পূণ্যার্জন করেন এবং মেলার আনন্দ উপভোগ করেন। লোকমুখে শোনা যায় একসময় এই মেলাগুলোতে দেশি - পলি সমাজের মানুষজন চাষের জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখে গরু-মহিষের গাড়ি করে মেলার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তো। সাত-দশদিন মেলার মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে বারুণী স্নানের উৎসবে মেতে উঠতেন এবং রান্না খাওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করে নিতেন।

পূর্বের চেয়ে এতদাঞ্চলে জনবসতির ঘনত্ব বাড়তে থাকে তাই নিজ নিজ এলাকায় বারুণী স্নান উৎসব ও মেলার আয়োজন বৃদ্ধি হয়েছে। জনৈক এক শ্মশান সন্ন্যাসী আমতলী ঘাটে বারুনী স্নান উৎসব ও মেলার আয়োজন করেন ১৯৯৫ সালে। আমতলী হতে আরও বেশ কয়েক কিমি দক্ষিণে গোলাবাড়ি ঘাটেও একটি মেলা বসে। যা ১৯৯৮ সালে প্রথম শুরু হয়। নওগাঁ - করদহ ঘাটেও নতুন মেলার শুরু হয় ২০০৩ সালে।

মেলা মানেই মিলনক্ষেত্র, মেলা মানেই আনন্দ উৎসব। জিলিপি আর পাঁপড় ভাজার গন্ধ এখনও মেলায় পাওয়া যায়। কিন্তু কিছু জিনিস আজ হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে।বায়োস্কোপ দেখা, পুতুল নাচ, রিং খেলা, জল ভর্তি বালতির মধ্যে একটি ছোট গ্লাস বসানো থাকে ওই গ্লাসের মধ্যে কয়েন ফেললে বা একটি হাঁড়ি বা ঘটের উপর একটি ডান্ডা , ডান্ডার নিম্নভাগে কাপড় দিয়ে বল মত বানিয়ে বসানো থাকতো আর ডান্ডার উপরিভাগে খুচরো পয়সা বসিয়ে অন্য একটি ছোট লাঠি দিয়ে দাঁড় করানো ডান্ডায় আঘাত করে হাড়ির  মধ্যে পয়সা ফেলতে পারলে দ্বিগুণ পয়সা পাওয়া যেত। এসব খেলা এখন আর দেখা যায় না।  এর পরিবর্তে ছয় বলের খেলা, কুপন লটারী জায়গা করে নিয়েছে।বায়োস্কোপের স্থিরচিত্র প্রদর্শনীর জায়গা নিয়েছে চিত্রাহার, হারিয়ে গেছে তালপাতার খেলনা , চড়কা, বাঁশি বিক্রিও তেমন দেখা যায় না বললেই চলে। 

বারুণীকে লোকমুখে বান্নি বলতেও শোনা যায়। এই মেলা স্থানভেদে একদিন, তিনদিন, সাতদিন পর্যন্ত হয়। স্নানোৎসবে হিন্দু পুণ্যার্থীরাই অংশগ্রহণ করলেও সকল ধর্মের মানুষই মেলায় অংশগ্রহণ করে।মেলায় মিষ্টান্ন ,চাইনিজ খাবার ,মনিহারি ,কাটা কাপড়, খেলনা, দা-কুড়াল, আসবাবপত্র,চপ- ঘুঘনি,পাঁপড় ভাজা, জিলিপির দোকান বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও বিনোদনের জন্য নাগরদোলা, সার্কাস ,যাত্রা, ব্রেক ডান্স, অ্যানাকোন্ডার রেস, কিছু কিছু জায়গায় এখনও পুতুল নাচ দেখানোর ব্যবস্থা থাকে।

উত্তরবঙ্গ জুড়ে এত সংখ্যক মেলা অনুষ্ঠিত হলেও অনেক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মেলার জৌলুস আর আগের মত নেই। তবুও নিয়ম করে মেলা তার সাবলীল ধারাকে বজায় রেখেছে আজও মানুষের মধ্যে। আপামর বাঙালির ভাবাবেগের এই ঐতিহ্যপূর্ণ সংস্কৃতিকে মেলা প্রাণের স্পন্দন দিয়ে চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে....


শুভঙ্কর রায়
করদহ,তপন,দক্ষিণ দিনাজপুর। 
কথাঃ ৯৭৩৫০৬৯৫৯৪
পেশা: ব্যবসা।
লেখালেখি: অনুগল্প ,নাটক , লোকসংস্কৃতি, ইতিহাস , ঐতিহ্য অনুরাগী।

দিনাজপুর জেলার ইতিহাস অনুসন্ধান দ্বিতীয় খণ্ড

দিনাজপুর জেলার ইতিহাস অনুসন্ধান ( দ্বিতীয় খণ্ড ) দিনাজপুর জেলার ইতিহাস অনুসন্ধান দ্বিতীয় খন্ড  প্রকাশক : চক্রবর্তী এন্ড সন্স পাবলিকেশন  সম...